শ্রীলঙ্কায় জঙ্গিহানা: নড়বড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ঘটনা শক্ত করবে কট্টরপন্থী রাজাপক্ষের হাত
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় গতকাল, ২১ এপ্রিল, ঘটে গেল এক বীভৎস সন্ত্রাসবাদী হানা। সারা দেশজুড়ে আটটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণে মারা গেলেন প্রায় ৩০০ মানুষ, আহত আরও প্রচুর।
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় গতকাল, ২১ এপ্রিল, ঘটে গেল এক বীভৎস সন্ত্রাসবাদী হানা। সারা দেশজুড়ে আটটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণে মারা গেলেন প্রায় ৩০০ মানুষ, আহত আরও প্রচুর। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন বেশ কিছু বিদেশীও। ইস্টার উদযাপনের সময়ে এই আক্রমণ ভারত মহাসাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটিকে এতটাই হতবাক করে দিয়েছে যে কর্তৃপক্ষও প্রতিক্রিয়া দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছেন। কার্ফু জারি হয়েছে, নানা ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব শোনা যাচ্ছে কারা আছে এই আক্রমণের পিছনে তা নিয়ে, কিন্তু কোনও সঠিক দিশা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
শ্রীলঙ্কার এই আক্রমণ মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় মুম্বইতে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের সেই সন্ত্রাস হানা। সেবারে ম্যাক্সিমাম সিটি-তে তাণ্ডব চালিয়েছিল পাকিস্তান থেকে আসা কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী; মারা গিয়েছিল ১৬০-এর উপরে মানুষ যাদের মধ্যে ছিলেন বহু বিদেশীও। যদিও শ্রীলঙ্কার হানাটি কিছুটা আলাদা কারণ এখানে কে দায়ী তা এখনও জানা যায়নি এবং মুম্বইতে আজমল কাসবের মতো কোনও সন্ত্রাসবাদী ধরা পড়েনি। আক্রমণের ব্যাপ্তিও ছিল সারা দেশ জুড়ে, শুধুমাত্র একটি শহরে নয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা অন্যতম কারণ
কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এই হানা চালানোর পিছনে কারণ কী? দেশটির অতীত হিংসা বিদীর্ণ হলেও বছর দশেক আগে এলটিটিই-র পতনের পরে স্থিতিশীলতার পথে অনেকটাই এগিয়েছিল তারা। মাঝেমধ্যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি যে একেবারেই হয়নি তা নয়, কিন্তু তা এই মাত্রায় হয়নি। অতএব, ২১ এপ্রিলের এই হানা যে শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার লক্ষ্যে চালানি হয়েছিল, তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। যদিও শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই ও সরকারের সংঘাতের সময়েও অসংখ্য হানাহানির ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু সেই সংঘাতের সঙ্গে এই আক্রমণের সাযুজ্য কম। বরং এই আক্রমণের সঙ্গে অনেক বেশি মিল রয়েছে আজকের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কাজের ধরনের সঙ্গে -- যেমন আল কায়দা এবং ইসলামিক স্টেট্। কিন্তু কিছু শ্রীলঙ্কান আইএস-এ যোগ দিলেও ওই জঙ্গি সংগঠনগুলির এ যাবৎ দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রে উপস্থিতির কোনও উল্লেখ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শ্রীলঙ্কার মাটিকে ফের নড়বড়ে করে তোলা। দেশটিতে খ্রিশ্চান এবং মুসলমান -- এই দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ইদানিংকালে রেষারেষি বেড়েছে। পাশাপাশি, বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু দেশটিতে জাতীয়তাবাদী জিগিরও শক্তিশালী হয়েছে। গত বছর, একটি মসজিদে বৌদ্ধ সমর্থকরা আক্রমণ চালানোর পরে পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্র কড়া হয়ে নাগরিক অধিকার ইত্যাদির উপরে খড়গহস্ত হলে যে কায়েমী স্বার্থের সুবিধে, সে নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই।
বিদেশীদের প্রাণনাশ করা মানে আন্তর্জাতিক দৃষ্ট আকর্ষণ
দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটনের উপরে নির্ভরশীল। আর রবিবারের আক্রমণের ধরন, যেখানে লক্ষ্য করা হয়েছে সাধারণ মানুষ এমনকী, বড় হোটেলগুলিকেও, তাতে এটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে একদিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির উপরে আঘাত হানা ও অন্যদিকে বিদেশী পর্যটকদের প্রাণনাশের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকে আকর্ষিত করা, জঙ্গি হানার হোতারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন বিভাজিত; আর তাতেই সোনায় সোহাগা জঙ্গিদের
তবে সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব বিভক্ত এবং দুর্বল। গতবছর ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন রাষ্ট্রপতি মৈথ্রিপালা সিরিসেনা যদিও পরে সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রবল জন প্রতিক্রিয়ায় বিক্রমসিংহকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন সিরিসেনা। কিন্তু দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক যে স্বাভাবিক হয়েছে, সে কথা এখনও বলা চলে না। ২০১৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে হারাতে হাত মিলিয়েছিলেন সিরিসেনা এবং বিক্রমসিংহ কিন্তু এখন এই দুই নেতার মধ্যে সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয়েছে যে দেশের মানুষ সরকারের মধ্যে বিভাজন এবং তার অকর্মণ্যতা নিয়ে বিরক্ত। রবিবারের আক্রমণ নিয়ে নাকি গোয়েন্দারা দিন দশেক আগেই সাবধান করেছিলেন কর্তৃপক্ষকে কিন্তু তার পরেও এই অঘটন থামানো না যাওয়াতে ক্ষিপ্ত শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যম থেকে সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বিক্রমসিংহও এই ঘটনাটিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে পরোক্ষে সিরিসেনা প্রশাসনকেই দুষেছেন বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা যে জঙ্গিদের আরও উদ্বুদ্ধ করেছে সে নিয়েও কোনও দ্বিমত নেই আর এর ফলে যে রাজাপক্ষের মতো কট্টরপন্থী নেতার হাত আরও শক্ত হবে সে নিয়ে সন্দেহ নেই।