ঐতিহ্য ও ইতিহাসে মোড়া বীরভূমে রবি ঠাকুর ও বীরের উপাখ্যান
কারও কাছে লালমাটি, মেঠো পথ, কোপাই-খোয়াই, আদিবাসী-সাঁওতাল কিংবা রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন-পৌষমেলা-বসন্ত উৎসবে বেঁচে থাকা ঠিকানার নাম বীরভূম।
কারও কাছে লালমাটি, মেঠো পথ, কোপাই-খোয়াই, আদিবাসী-সাঁওতাল কিংবা রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন-পৌষমেলা-বসন্ত উৎসবে বেঁচে থাকা ঠিকানার নাম বীরভূম। কারও মননে নিহীত তারাপীঠ, কঙ্কালীতলা, বক্রেশ্বর, জয়দেব-কেন্দুলির ভক্তি, ঐতিহ্য ও আবেগ। আউল-বাউল ও মেলা-পার্বনের এই জেলায়, পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়ানো ইতিহাসকে ধরা কী সহজ! তবু চেষ্টা তো করাই যায়। এক নজরে জেনে নেওয়া যায় ঐতিহাসির বীরভূমের বুৎপত্তি, উত্থান ও সম্প্রসার।
কেন বীরভূম
অনেকের মতে, 'বীরভূম' নামের অর্থ 'বীরভূমি' বা 'বীরের দেশ'। অন্য মতে, বীরভূমের নামকরণ হয়েছে বাগদী রাজা বীর মল্লের নাম অনুসারে। আরও একটি সূত্রের মতে, সাঁওতালি ভাষায় 'বীর' শব্দের অর্থ 'বন'। সে অনুযায়ী বীরভূম শব্দের অর্থ 'বনভূমি' হতেও পারে।
ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও নদ-নদী
৪৫৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বীরভূমের নিচের দিকে অবস্থান অজয় নদের। যা এই জেলাকে বর্ধমান থেকে আলাদা করেছে। বীরভূমের পূর্ব দিকে মুর্শিদাবাদ। পশ্চিম ও উত্তর সীমান্ত বরাবর ঝাড়খণ্ড, বীরভূমের পাশে বসে। ভৌগলিক বিচারে ছোটনাগপুর মালভূমির উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত বীরভূম। লাল মাটির এই জেলা সাধারণত রুক্ষ, শুষ্ক ও চরম প্রকৃতির। গ্রীষ্মে এই জেলার তাপমাত্রা কখনও-সখনও ৪৫ ডিগ্রি ছাপিয়ে যায়। শীতকালে আবার পারদ নামে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে। বিভিন্ন স্থানে অনিয়মিত বৃষ্টি, বীরভূমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অজয় ছাড়াও ময়ূরাক্ষী, কোপাই, বক্রেশ্বর, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, পাগলা, হিংলো, চপলা, বাঁশলই নদী এই জেলাকে ঘিরে রেখেছে।
কীভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে বীরভূমের দূরত্ব প্রায় ১৮৯ কিলোমিটার। শিয়ালদহ কিংবা হাওয়া থেকে বোলপুর কিংবা রামপুহাটে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া এখন প্রায় জলভাত। অন্যদিকে, ১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বর্ধমান ও অজয় নদ পেরিয়ে গাড়িতেও পৌঁছে যাওয়া যায় বীরভূমে।
ইতিহাস
কথিত আছে, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রচারকদের প্রভাব কমে যাওয়ার পর রাঢ় বীরভূম মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। বাংলার এই অঞ্চল শাসন করেন গুপ্ত, শশাঙ্ক, হর্ষবর্ধনরাও। এরপর আসে পাল, তারপর সেন। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বীরভূম সহ রাঢ় অঞ্চলের অধিক অংশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারই মধ্যে রাজত্ব ধরে রাখেন বীর রাজবংশের সদস্যরাও। আবার পুরাণ মতে, বীরভূম তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের পীঠভূমি। বেশ কয়েকটি সতীপীঠ বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকা বীরভূমে শক্তিদেবীর আরাধানা হয় সর্বত্র। কবি জয়দেব, চণ্ডীদাস, সাধক বামাখ্যাপা ও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি ধন্য বীরভূম বাংলার গর্ব।
আধুনিক সময়
আগে মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত ছিল এই জেলা। ১৭৮৭ সালে বীরভূমকে প্রথম প্রশাসনিক জেলার স্বীকৃতি দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তখন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর ও সাঁওতাল পরগণা ছিল বীরভূমের অন্তর্গত। কিন্তু পশ্চিমে সাঁওতাল বিদ্রোহ সামাল দিতে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে বীরভূম থেকে বাদ দেয় ইংরেজরা। একই সঙ্গে বীরভূম থেকে বিষ্ণুপুরও আলাদা করে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। সেই সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই বীর সেনানী সিধু ও কানহো ছিলেন এই জেলারই সন্তান। এহেন ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলার কিছু দর্শনীয় স্থানের বিশেষত্ব তুলে ধরা হল এই লেখনিতে।
শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী
প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনি সৃষ্ট এই উক্তি বীরভূমের ঐতিহাসিক শান্তিনিকেতনে এখনও অনেকটাই প্রাসঙ্গিক। যে স্থানে ১৮৬৩ সালে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মাচারণের জন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে ওই স্থানেই ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরে শাখা-প্রশাখা মেলে বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ের রূপ নেয়।
শিক্ষা হবে প্রাণখোলা, প্রকৃতি-বান্ধব - গুরুদেবের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা ছিল এই শিক্ষা নিকেতনের মূল আকর্ষণ। অন্য ধারার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচিরেই দেশের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থানে পরিণত হয়। যেখানে একদিকে চলে আরাধনা এবং অন্য দিকে শিক্ষার প্রসার।
রথি-মহারথিদের পদধূলি খ্যাত বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করেছেন ভারতের বহু কৃতী। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে সজ্জিত এই আশ্রম এখন পর্যটনস্থলে পরিণত। পৌষমেলা, মাঘমেলা, হলকর্ষণ, আনন্দমেলা, বসন্ত উৎসব, বর্ষামঙ্গল উৎসব ও ছায়া-সুনিবিঢ় ক্যাম্পাস এই স্থানের অন্যতম আকর্ষণ। শ্রীনিকেতনে রবি ঠাকুরের পল্লী পুনর্গঠনের ভাবনা এ যুগেও অনুকরণীয়। এবার পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে নজর ফেরানো যাক।
প্রার্থনাস্থল
১) পুরাণে কথিত ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম কঙ্কালীতলা মন্দির বীরভূমের নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। বলা হয়, দক্ষযজ্ঞের পর দেবী পার্বতীর দেহের কঙ্কাল এই স্থানে পড়েছিল। তাই এই এলাকার নাম কঙ্কালীতলা। এখানে দেবী দেবগর্ভা হিসেবে পূজিত হন। আর ভৈরবের নাম রুরু। প্রতি কালী পুজোর অমাবস্যার রাতে এই মন্দিরে রীতি মেনে শান্তি যজ্ঞ হয়ে থাকে।
২) নলাটেশ্বরীর মন্দির পুরাণে কথিত আরও একটি সতীপীঠ, যেটি বীরভুমের অন্যতম আকর্ষণ স্থল। নলহাটি স্টেশনের নিকট কোনও এক স্থানে দক্ষযজ্ঞের পর দেবী পার্বতীর শ্বাসনালী সহ কণ্ঠনালী পড়েছিল বলে লোকমুখে প্রচারিত। বলা হয় নাকি স্বপ্নাদেশে কামদেব, সতীর সেই কণ্ঠনালী উদ্ধার করেন। ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নিচে তার ওপর বেদী প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম দেওয়া হয় দেবী নলাটেশ্বরীর মন্দির। দেবী এখানে কালিকা রূপে পূজিত হন। আর ভৈরব এখানে যোগেশ।
৩) বীরভূমের সাঁইথিয়া শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত নন্দীকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে মিথ কিছু কম নেই। পুরানে কথিত আছে যে দক্ষযজ্ঞের পর দেবী পার্বতীর গলার হার নাকি এই এলাকায় পড়েছিল। দেবী এখানে নন্দিনী হিসেবে পূজিত হন। ভৈরব এখানে নন্দিকেশ্বর।
৪) কথিত আছে, দক্ষযজ্ঞের পর মহাদেব যখন দেবী পার্বতীর মৃতদেহ নিয়ে ব্রহ্মাণ্ডে প্রলয়-নাচন শুরু করেছিলেন, তখন ভগবান বিষ্ণুর চক্রে খণ্ডিত সতীর ভ্রূণের মধ্যবর্তী অংশে বা মন বক্রেশ্বরে পড়েছিল। সেই মিথকে কেন্দ্র করেই এখানে তৈরি করা হয় মন্দির। বক্রেশ্বরের উষ্ণ-প্রস্রবন ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য। ১০৫০ মেগাওয়াট সম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও বক্রেশ্বরের অন্যতম আকর্ষণ।
৫) বীরভূমের লাভপুরের কাছে ফুল্লরায় দেবীর ঠোটের নিচের অংশ পড়েছিল বলে পুরানে কথিত আছে। দেবী এখানে ফুল্লরা হিসেবে পূজিত হন। ভৈরব এখানে বিশ্বেশ।
৬) সাধক বামাখ্যাপার চারণক্ষেত্র রামপুরহাটের অন্যতম আকর্ষণ পবিত্র তারা মায়ের মন্দির। যেখানে সাধক, দেবীর সঙ্গে নিত্য কথা বলতেন বলে লোকমুখে প্রচারিত। মন্দির সংলগ্ন শ্মশানে তপস্যা করতেন বামদেব। বীরভূমের মারগ্রাম থানার সাহাপুর গ্রামের এই মন্দির শাক্তধর্মের পবিত্র সতীপীঠের অন্যতম বলে ধরা হয়।
৭) গীত গোবিন্দ-র রচয়িতা তথা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব, দ্বাদশ শতকে বীরভূমের এই স্থানেই জন্মগ্রহণ করেন বলে মনে করা হয়। এও মনে করা হয় যে কবি নিজে হাতে এই গ্রামে রাধামাধবের পুজো শুরু করেছিলেন। কবি জয়দেব যে আসনে বসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তা সংরক্ষণ করা হয়েছে। অন্য সূত্রের মতে, বর্ধমানের রাজ দরবারের সভাকবি যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে মহারানী ব্রজকিশোরী, ১৬৮৩ সালে জয়দেবের জন্মভিটেয় রাধাবিনোদ মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেই মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বছরই কেন্দুলিতে মেলা বসে। আউল-বাউলের আখড়ায় ভিড় করেন বহু মানুষ।
৮) বোলপুর থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নানুর, বৈষ্ণব পদাবলীর রচয়িতা কবি চণ্ডীদাসের জন্মস্থান। ১৪ শতকে যে স্থানে জন্ম নেন কবি, সেখানে তৈরি করা হয়েছে সৌধ।
৯) বীরভূমের দুবরাজপুর শহরের কাছে ছোট নাগপুর মালভূমির পূর্ব ভাগে অবস্থিত এই পাহাড় এলাকার ব্যতিক্রমী। কথিত আছে, শ্রী রাম যখন সীতাকে উদ্ধারের উদ্দেশে লঙ্কা যাত্রা করেছিলেন, সঙ্গে হিমালয় থেকে সেতু বন্ধনের পাথরও রথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সেই রথ থেকে কিছু পাথর পড়ে এই পাহাড় তৈরি হয়েছিল বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস।
১০) সিউড়ির পাথরচাপুড়িতে দাতা মেহেবুব শাহ ওয়ালির সৌধ সম্বলিত দরগা বীরভূমের অন্য এক আকর্ষণ বলা চলে।
লাল মাটির দেশ ও আদিবাসী গ্রাম
লাল মাটির পথ এবং সোনাঝুরি, শাল, অর্জুন, কেন্দ, মহুয়া গাছের বন বীরভূমের অন্যতম আকর্ষণ। যেখানে তিতির, পায়রা, দোয়েল, ফিঙে, কোকিল, তোতা পাখির নিত্য আানাগোনা। সাঁওতাল পরগণা থেকে আলাদা হলেও বীরভূমের (বোলপুর, শান্তিনিকেতন কেন্দ্রীক) বেশকিছু অংশে আদিবাসীদের বংশোধররা রয়ে গিয়েছেন। তাঁদের ঘিরে তৈরি হয়েছে গ্রাম। আদিবাসীদের পার্বন ও অভ্যাস দেখতে সেই গ্রামগুলিতেও ভিড় জমান পর্যটকরা।