বহিরাগতদের নেপথ্যে কে? তিন বছর পর কোন পথে সংগঠিত ভাঙড়ের জমি আন্দোলন?
জমি আন্দোলনে উত্তপ্ত ভাঙড়। জ্বলছে গ্রাম। পিছনে কে? কার ইন্ধনে হচ্ছে এসব? এরই মধ্যে বারবার একটা নাম ঘুরে ফিরে আসছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ১৮ জানুয়ারি : জমি আন্দোলনে উত্তপ্ত ভাঙড়। জ্বলছে গ্রাম। পিছনে কে? কার ইন্ধনে হচ্ছে এসব? এরই মধ্যে বারবার একটা নাম ঘুরে ফিরে আসছে। সেই নাম তৃণমূল নেতা ভাঙড়ের 'ডন' আরাবুলের। গ্রামবাসীরা দাবি করে আসছিলেন, পুলিশের আড়ালে বহিরাগতরা এই হামলা চালিয়েছে। তাঁদের যুক্তি ছিল, পুলিশ গুলি চালাতে পারে, কখনও বোমাবাজি করবে না।[ভাঙড়ের ঘটনা তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ : রাহুল সিনহা ]
কিন্তু দেখা গিয়েছে গ্রামে ঢুকে বোমাবাজি করে একটার পর একটা বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে তারা। পুলিশের উর্দি পরে যে এই কাজ করেছে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা, তার প্রমাণ মিলেছে ইতিমধ্যে। গ্রাম থেকেই উদ্ধার হয়েছে পুলিশের উর্দি।[মুখ্যমন্ত্রীর আসা চাই, নতুবা থামবে না আন্দোলন, সাফ জানালেন আন্দোলনকারীরা ]
তবে কি আরাবুলেরই হাত রয়েছে গুলি চালানো থেকে শুরু করে ভাঙচুর, অত্যাচারের ঘটনায়? কেননা শুরু থেকেই আরাবুলের দিকে অভিযোগের তির। জোর করে জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে জমি আন্দোলনে উত্তপ্ত ভাঙড়ে গুলিকাণ্ড- সবকিছুতেই গ্রামের মানুষের মুখে একটাই নাম আরাবুল। এমনকী বিধায়ক-মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাও নাম না করে আঙুল তুলেছেন আরাবুলের দিকে। পরোক্ষে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না রেজ্জাকও।[ভাঙড়ে যে গুজবের কারণে পাওয়ার গ্রিডের জমি নিয়ে আন্দোলনে গ্রামবাসীরা]
এদিকে তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যে গ্রামে ঢুকে পড়েছে অনেক বহিরাগত সংগঠন। তাঁরাই এই আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছে বলে অভিযোগ। তারাই ভাঙড়ের আন্দোলনকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের চেহারা দিচ্ছে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনেও এই সংগঠনের হাত ছিল। পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে বাধাদান থেকে শুরু করে গাছের গুঁড়ি ফেলে ৩০-৩৫ জায়গায় রাস্তা আটকে দেওয়া, পুলিশকে ফাঁদে ফেলা- সর্বত্রই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ছাপ স্পষ্ট। কোনওভাবেই পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া যাবে না, তা নিশ্চিত করতেই সাজানো চক্রব্যুহ।[পুলিশের পোশাকে গুলি চালিয়েছে বহিরাগত দুষ্কৃতীরাই! উদ্ধার পুলিশের উর্দি]
২০১৩ সালে ভাঙড়ে সাব স্টেশনের জন্য জমি নেওয়ার কাজ শুরু হয়। তখন এলাকায় একছত্র দাপট আরাবুলের। অভিযোগ, আরাবুল তখন গায়ের জোরে জমি দখল করে নেয়। কোনও আমলই দেয়নি গ্রামবাসীদের দাবির। হাইটেনশন লাইনের তার টানা যাবে না, পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প করা যাবে না, কোনও কিছপুই ধোপে টেকেনি আরাবুলের কাছে।[অশান্ত ভাঙড়, নিজের এলাকায় ঢুকতেই পারলেন না রেজ্জাক]
সিন্ডিকেট রাজ ব-কলমে চালিয়ে এসেছেন আরাবুল। এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায় সেসব কাহিনি। সাব স্টেশনের জন্য কাঁচামাল থেকে শুরু করে যাবতীয় সামগ্রী সরবরাহ করে এসেছেন তিনিই। ফলে যাবতীয় সুবিধা ভোগ করেছেন আরাবুল।[জোর করে জমি অধিগ্রহণ নয়, প্রয়োজনে পাওয়ার গ্রিড সরানো হবে : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়]
কিন্তু ছবিটা পুরোপুরি বদলে যায় বিধানসভা ভোটের আগে। ভাঙড়ে তৃণমূলের টিকিট পান রেজ্জাক মোল্লা। এতদিন যিনি ছিলেন বিরোধী সিপিএম শিবিরে। তিনিই জার্সি বদল করে ভাঙড়ের জন প্রতিনিধি বনে গেলেন। তারপর রেজ্জাক হয়ে গেলেন মমতা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও। বদলে গেল পুরো রাজনৈতিক সমীকরণ।[ভাঙড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত ২ গ্রামবাসী]
এলাকায় আরাবুল বিরোধী বলে পরিচিত-রা ঝুঁকে পড়লেন রেজ্জাক শিবিরের দিকে। আরাবুলের ক্ষমতা খর্ব হতে শুরু করল। যাঁরা এতদিন আরাবুলের দাপটে সিঁটিয়ে থাকত, তারাই চলে এল প্রথম সারিতে। আরাবুলকে বাগে পেয়ে তাঁকে একেবারে কোণঠাসা করে ছাড়ল নান্নু হোসেন, ওহিদুল ইসলামরা।[ভাঙড় : মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২, রাতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না গ্রামে, পাহারায় গ্রামবাসীরাই]
আন্দোলন শুরু হল পাওয়ার গ্রিডের প্রতিবাদে। জীবন-জীবিকা-বাস্তুজমি বাঁচাও কমিটি গঠন হল। সেই আন্দোলনে যুক্ত হল বিভিন্ন সংগঠন। যাদবপুরের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীও যুক্ত হয়ে পড়েন ভাঙড়ের জমি আন্দোলনে।[মুখ্যমন্ত্রী বা বিদ্যুৎমন্ত্রীকে এসে পাওয়ার গ্রিড বন্ধের আশ্বাস দিতে হবে, নতুবা আন্দোলন চলবে]
এমন অনেক সংগঠন এই আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে, যাদের পুরনো অভিজ্ঞতা রয়েছে আন্দোলনকে সংগঠিত করার। তাঁদের দেখানো পথেই ভাঙড় আন্দোলন প্রসারিত হচ্ছে। পুলিশ পড়ে যাচ্ছে ফ্যাসাদে।[নন্দীগ্রামের ধাঁচে জমি আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ ভাঙড়, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে যাচ্ছেন রেজ্জাক]