৭৪ পূর্ণ নবীন পট্টনায়েকের, দুই দশক ধরে কীভাবে ওড়িশার মন জয় করে আসছেন এই জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী
৭৫-এ পা দিলেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজু জনতা দলের প্রধান নবীন পট্টনায়ক। তবে ওড়িশার এই জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান গুরুগম্ভীর পরিস্থিতিতে তাঁর জন্মদিন পালন করবেন না বলে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
এই বছরের মার্চ মাসে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কুড়ি বছর পূর্ণ করেছেন নবীন পট্টনায়েক। রাজ্যের সবচেয়ে বেশিদিন দায়িত্ব সামলানো মুখ্যমন্ত্রী তিনি। তবে ততদিনে ভারতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব রীতিমতো শুরু হয়ে গিয়েছে।
নবীন পট্টনায়কের বাবা বিজু পট্টনায়েক কোনওদিন চাননি তাঁর পরিবারের কোনও সদস্য রাজনীতিতে আসুক। তবে তাঁর প্রয়াণের পর ১৯৯৭ সালে দলের অন্য সহকর্মীরা বিজু পট্টনায়কের লোকসভা আসনে উপ-নির্বাচনে নবীনকে দাঁড় করিয়ে দেন। সেই সময় নবীন পট্টনায়েক জনতা দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার পরে দল ভেঙে বেরিয়ে এসে ওড়িশার জন্য আলাদা আঞ্চলিক দল তৈরি করলেন নবীন। যার নাম দিলেন বিজু জনতা দল।
তারপর থেকে বিজু জনতা দল ওড়িশায় সেভাবে হারের মুখ দেখেনি। প্রথম নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে নিয়ে জেতার পরে নিজের পরিচিতি তৈরি করেন নবীন। এবং ২০০৯ সালের পর থেকে একক দক্ষতায় তিনি দলকে ওড়িশায় জিতিয়ে আসছেন।
এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ওড়িশা বিধানসভায় একটি রেজোলিউশন পাস হয়। যেখানে ওবিসি বা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়কে টেনে তোলার জন্য একটি সমীক্ষা করা হয় সামাজিক এবং শিক্ষাগত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। যে সমীক্ষার ভিত্তিতে রাজ্য কেন্দ্রকে ২০২১ সালের জনগণনায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেয়। এর ফলে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি উপকৃত হতে চলেছে অনেকাংশে।
নবীন পট্টনায়েক সবসময় জনতার মাঝে থেকে সরকার চালাতে ভালোবাসেন। আর সেই প্রেক্ষিতে তিনি পাঁচটি বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তা হল - প্রযুক্তি, স্বচ্ছতা, প্রতিষ্ঠা, সময় ও বদল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা আধিকারিকরা নিজেরা সাধারণ মানুষকে ফোন করে তাঁদের অভাব-অভিযোগ জানার চেষ্টা করেন। নবীন পট্টনায়েক একজন ব্যক্তিগত সচিব রেখেছেন। যিনি নিজে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে গিয়ে সাধারণ মানুষ সরকারি প্রকল্পের সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা তা তদারকি করেন।
স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নবীন পট্টনায়েক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। সম্প্রতি জনতা দলের এক বিধায়ক আয় বহির্ভূত সম্পদ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এমনকি বেশ কিছু অসাধু সরকারি আধিকারিককেও তাদের পথ থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে বা তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নবীন পট্টনায়েক দায়িত্ব নেওয়ার পরেই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিভিন্ন সাইক্লোনে বিধ্বস্ত ওড়িশাকে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে দেওয়া। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে ওড়িশাকে প্রতিবছর ছোট-বড় নানা ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নবীন পট্টনায়ক চেষ্টা করেছেন যাতে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দলটি ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তৈরি থাকে এবং তার এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে ও আন্তর্জাতিক প্রশংসা, স্বীকৃতিও পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যেমন প্রধানমন্ত্রী কিষাণ যোজনা রয়েছে, সেরকমই ওড়িশায সরকার নবীন পট্টনায়কের সময়ে কালিয়া প্রকল্প কৃষকদের জন্য চালু করেছে। দরিদ্র মানুষদের জন্য প্রতি কেজি ১ টাকা দরে চাল দেয় সরকার।
গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক দিক থেকে ওড়িশা অনেক ভালো কাজ করেছে। জাতীয় গড়ের থেকে রাজ্যের গড় বৃদ্ধি অনেক বেশি। গত সাত বছরে রাজ্যের গড় বৃদ্ধি ৮% হারে হয়েছে। যেখানে কেন্দ্রীয় গড় ৬.৯ শতাংশ। এমনকি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী নিরঞ্জন পূজারী দাবি করেছেন, জাতীয় ও বিশ্ব অর্থনীতি নানা কারণে থমকে গেলেও ওড়িশার অর্থনীতি একটি নির্দিষ্ট হারে বেড়ে চলেছে। জাতীয় গড়ের থেকে যা অনেকটাই বেশি।
ওড়িশা যে ক্রমে বিনিয়োগের অন্যতম সেরা গন্তব্য হয়ে উঠছে তা বলা যেতে পারে। কারণ ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, গোটা দেশে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার মধ্যে ১৮% শুধুমাত্র এই রাজ্যে হয়েছে। কৃষি থেকে শিল্প - নানা ক্ষেত্রে কেন্দ্রের প্রশংসা পেয়েছে ওড়িশা।
গত মার্চ মাসে নবীন পট্টনায়ক ঘোষণা করেছেন, আগামী চার বছরের মধ্যে রাজ্যের দরিদ্রদের কুড়ি লক্ষ পাকা বাড়ি তিনি তৈরি করে দেবেন। এর আগে ২৫ লক্ষ কংক্রিটের বাড়ি ইতিমধ্যে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। নবীন পট্টনায়ক মিশন শক্তি নামে নতুন একটি দপ্তর চালু করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য।
করোনা ভাইরাস সামলানো নবীন পট্টনায়কের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে সেই চ্যালেঞ্জকে দারুণভাবে গ্রহণ করে সফল তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু করোনা ঠেকাতে নবীন পট্টনায়কের ওড়িশা সরকারের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এক্ষেত্রে নবীন পট্টনায়ক নিজের রাজ্যে যে বিপর্যয় মোকাবিলা দল তৈরি করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা দারুণ কাজে দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, মার্চ মাসের ১৫ তারিখ যখন ওড়িশায় প্রথম করোনা সংক্রমণের ঘটনা ধরা পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল রুম তৈরি করে তদারকি শুরু হয়ে যায়। জেলা স্তরে স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সতর্ক করে জনসচেতনতা শুরু করে সরকার। যার ফলে ওড়িশায় এই ভাইরাস ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এবং প্রাণহানি কম হয়েছে।