পাহাড়ের কোলে জয়ন্তী-বক্সার অপরূপ শোভা, গরুমারায় এক রহস্যময় ডুয়ার্স
মূর্তি নদীকে ঘিরে থাকা অরণ্য, সুদূর বিস্তৃত টি এস্টেট, আঁকাবাঁকা পথ যেন কোনও কল্প রাজ্য।
মূর্তি নদীকে ঘিরে থাকা অরণ্য, সুদূর বিস্তৃত টি এস্টেট, আঁকাবাঁকা পথ যেন কোনও কল্প রাজ্য। শহুরে কোলাহলে মাখা পাওয়া না পাওয়ার হিসেব যেখানে অর্থহীন সেই ডুয়ার্স যে আমাদের মনপ্রাণ ইতিমধ্যেই জয় করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত তিন দিনের প্রাপ্তি সামসিং, ঝালং, বিন্দু, জলদাপাড়ার রেশ যেন কিছুতেই মন থেকে সরছে না। নৈসর্গিক পরিবেশে নিজেকে আপন করে নেওয়ার সুখ যে ঠিক কতটা, তা বলে বোঝানো মুশকিল। আরও আরও প্রাণ পাওয়ার বাসনা নিয়ে চতুর্থ দিনের সকাল দেখল চোখ। জানলাম, এবার ডুয়ার্স নেস্টকে (মূর্তি নদীর ধারের হোম স্টে) বিদায় জানানোর পালা। পরিমল রাহুত (ডুয়া্র্স নেস্টের মালিক) ও তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের আলবিদা জানিয়ে স্বপনের (গাড়ির চালক) রথ আমাদের নিয়ে রওনা হল জয়ন্তীর উদ্দেশে।
ডুয়ার্সের রানি জয়ন্তী
সকাল সাতটায় চালসা থেকে পত্রপাট জয়ন্তীর দিকে রওনা হলাম। ঘন জঙ্গলে ঢাকা আঁকাবাঁকা রাস্তা যেন কোনও অচিনপুরের পথ। সে পথে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। আচমকাই ব্রেক কষলেন স্বপন (গাড়ির চালক)। হতচকিত হয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে হরিণের বাহান্নবর্তী পরিবার। গাড়ির হর্ণকে থোড়াই কেয়ার! ভাবটা এমন এ যেন তাদেরই রাজত্ব। তোমরা কে হে! কোনও উপায় না দেখে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা সাফ করার দায়িত্ব নিলেন স্বপন।
আলিপুরদুয়ার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বক্সা জঙ্গলের ধার ঘেঁষা জয়ন্তীকে বলা হয় ডুয়ার্সের রানি। ভারত-ভূটান সীমান্তবর্তী পাহাড়ে ঘেরা জয়ন্তী নদীর ধারে এককালে কোনও গ্রাম ছিল বলে শোনা যায়। এখন তার অস্তিত্ব না থাকলেও রয়েছে অল্প বিস্তর চিহ্ন। গর্বের গতিপথ হারিয়েছে জয়ন্তী নদীও। তবু সৌন্দর্য্যে একফোঁটা ভাঁটা পড়েনি। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা নুড়ি-পাথরের শুকনো নদীপথে বিরাজমান অপার শান্তি। দুলতে দুলতে সেই পথ বেয়ে আমাদের গাড়ি যেখানে থামল সেখানে এখনও অবশিষ্ট নদীর কিছু লেশ। দুদিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার একটি উঠেছে ছোট মহাকালের দিকে এবং অন্যটির গন্তব্য বড় মহাকাল মন্দির।
ছোট মহাকাল মন্দির দর্শন
কাচের মতো স্বচ্ছ জল মাড়িয়ে আমরা সদলবলে ছোট মহাকাল মন্দির দর্শনে রওনা হলাম। চড়াই-উতরাইয়ে ভরা দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বিপজ্জনক ভাবে খাড়া লোহার সিঁড়ি বেয়ে যেখানে পৌঁছলাম, সেখানে ছোট মন্দিরের কান ঘেঁষে নেমে আসা পাহাড়ি ঝরনা নীরবতা ভেঙে চলেছে অবিরাম। গাছ-গাছালি দিয়ে ঘেরা সেই স্থানে পেলাম মনের আরাম, আত্মার শান্তি। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর নিচে নেমে এলাম। স্বপন (গাড়ির চালক) বললেন, বড় মহাকাল মন্দির অনেকটাই উপরে। ওখানে যেতে ট্রেকিংয়ের সরঞ্জাম থাকা আবশ্যক।
ফেরার পথে নজরে পড়ল পাহাড়ের কোলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ট্রেকারদের তাবুতে রঙিন হয়েছে বনানী। তারই নিচে এক স্থানে চলছে চড়ুইভাতি। মুগ্ধ চিত্তে সেসব দৃশ্যকে বিদায় জানালাম। পথিমধ্যে পুকুরি লেক ও চুনিয়া ওয়াচ টাওয়ারের শোভা উপলব্ধি করলাম।
বক্সা পাহাড়ের ইতিহাস
এবার আমাদের গন্তব্য বক্সা পাহাড়। ইতিহাস বলছে ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ভূটিয়াদের হটিয়ে বক্সাগিরি দুর্গের দখল নেয় ব্রিটিশরা। ১৯৩০-এ দুর্গ সংস্কার করে বন্দিশিবির গড়ে সেখানে অগ্নিযুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আটক রাখত প্রবল ইংরেজ। ১৯৫৯ সালে দালাই লামার সঙ্গে ভারতে আসা তিব্বতী শরণার্থীরা এখানেই আশ্রয়গ্রহণ করেন। শাল-সেগুন-শিশু-দেবদারু-শিমূল, ঝোপঝাড় ও গুল্মে ভরা ৭৬৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বক্সা অরণ্য। সুন্দরের মাঝে ডুকপাদের বাস। প্রকৃতির মতোই তাঁরা ঐকান্তিক। ১৯৯২ সালে ঐতিহ্যবাহী বক্সা অরণ্যকে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যা অগণিত গণ্ডার, হাতি, হরিণ, বাইসনের চারণক্ষেত্র।
সেদিনের পাট চুকিয়ে নিশিযাপনের উদ্দেশে ফিরলাম নিকটস্থ রাজাভাতখাওয়ায়। কথিত আছে, প্রায় ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে অরণ্যের রূপে মুগ্ধ হয়ে বক্সা দুয়ার দখল করেছিলেন ভূটানের রাজা। তা শুনে গোসা করেন কোচবিহারের রাজা। পণ করেন যে ভূটানিদের উচ্ছেদ করে তবেই অন্ন গ্রহণ করবেন। বিপদ বুঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সন্ধিতে রাজি হন ভূটানের ড্রুক। পণ ভাঙেন কোচ রাজা। যে স্থানে বসে তিনি ভাত খেয়েছিলেন, তার নাম দেওয়া হয় রাজাভাতখাওয়া।
সেখানেই একটি হোটেল দুটি ঘর আমাদের জন্য বুক করা ছিল আগে থেকে। রাতে ভাত, ডাল, আলু ভাজা, ছোট মাছ ও চাটনি সহযোগে উদরতৃপ্তির পর এলোমেলো আড্ডা চলল রাতভর। সঙ্গী হল নীরব নিশি, বাঁকা চাঁদ, ঝিঝির তান। দূরে ওই আদিবাসী গ্রামের কোনও ঘরে তখনও টিমটিম করে জ্বলছে লন্ঠন। কান পাতলেই সে ঘরে শোনা যায় ফিসফাস-গুঞ্জন। ভাষা বোঝা দায়। শুধু অচেনা পায়ের শব্দে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তি মাখা ভালোবাসাই সে রাতের অমোঘ টান। পরের দিনের গন্তব্য গরুমারা অভয়ারণ্য।
গরুমারা অভয়ারণ্য
ভোরে উঠে চটজলদি স্নান সেরে ব্রেক ফার্স্ট করে নিলাম। কারণ গরুমারা অভয়ারণ্য দর্শনের অনতিবিলম্বে নিউ মাল জংশনে আমাদের অপেক্ষায় কলকাতাগামী কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস দাঁড়াবে মোটে সাত মিনিট।
চাপা উত্তেজনা নিয়ে রওনা হলাম। মন হালকা করল স্বপনের গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে অবিরাম বেজে চলা পাহাড়ি শিল্পীর গান। গহীন অরণ্য, চা বাগান, নদী, ঝরনাদের পিছনে ফেলে অবশেষে গরুমারা স্যাঙ্কচুয়ারির মুখে দাঁড়াল রথ। গণ্ডার, হাতি, শম্বর, নানা প্রজাতির হরিণ, চিতাবাঘের দর্শন এখানে ঘটে আকছার। শীতে হর্নবিল, স্কারলেট মিনিভেট, রিভার ল্যাপউইংয়ের মতো পরিযায়ী পাখিরা এই স্থানের অন্য আকর্ষণ বলে জানালেন স্বপন।
গরুমারা অভয়ারণ্যে ঢোকার টিকিট দেয় বেশ কয়েক খেপে। প্রথম ট্রিপের জন্য গেট খোলে ৬টায়। অভয়ারণ্যে জন্তু-জানোয়ার দেখার জন্য সময় ধার্য করা এক ঘণ্টার কিছু বেশি। আমরা তৃতীয় সাফারির (বেলা ১২টা) জন্য পাস সংগ্রহ করলাম। জাম, শিরীষ, শিমূল, বহেড়া, কাটুস গাছের জঙ্গলের মধ্যে বয়ে চলা ইনডং ও মূর্তি নদীর শোভা অজানারে দেয় হাতছানি। জঙ্গলের সৌন্দর্য্য পর্যবেক্ষণ করা যায় রাইনোপয়েন্ট ও যাত্রাপ্রসাদ ওয়াচ টাওয়ারে উঠে।
গরুমারা অভারণ্য থেকে বেরিয়ে পাশেই এক বাঙালি হোটেলে লাঞ্চ সেরে নিউ মাল জংশনের পথে রওনা হলাম। আরও একবার কর্মব্যস্ত শহুরে জীবন শুরুর আগে চোখেমুখে শেষবারের জন্য মেখে নিলাম প্রকৃতির ঘ্রাণ।
অবশেষে জার্নি টু কলকাতা।
(শেষ কিস্তি)
[আরও পড়ুন:গহীন অরণ্যের মাঝে, ডুয়ার্সের জঙ্গলে কয়েকদিন]
[আরও পড়ুন:মূর্তি নদীর কান ঘেঁষা জলদাপাড়ার 'হলং', আশ্চর্য ডুয়ার্সে কয়েকদিন]