পাহাড়ে তিনিই ‘শের’! মমতাকে কোন শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করলেন বিমল গুরুং
মুখ্যমন্ত্রী পাহাড় সফরে যাওয়ার দিন থেকেই বিমল গুরুং তাঁর আন্দোলন কর্মসূচি সাজিয়ে রেখেছিলেন।কিন্তু কোনও আন্দোলনকেই দানা বাঁধতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক একটা মাস্টার স্ট্রোকে পাহাড়ে গত তিনদিনে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর সফরের একেবারে শেষবেলায় এসে ঝটকা দিতে কি পরিকল্পিতভাবে জঙ্গি আন্দোলনে নামল বিমল গুরুং-এর দল? এই প্রশ্নই এখন উঠতে শুরু করেছে।
মুখ্যমন্ত্রী পাহাড় সফরে যাওয়ার দিন থেকেই বিমল গুরুঙ্গ তাঁর আন্দোলন কর্মসূচি সাজিয়ে রেখেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো থেকে বাংলা ভাষা আবশ্যিক করা নিয়ে আন্দোলন। তারপর জিটিএ ত্যাগ করে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সরব হওয়া। কিন্তু কোনও আন্দোলনকেই দানা বাঁধতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মাস্টার স্ট্রোকে ক্রমশই পিছু হটতে হয়েছে মোর্চা নেতৃত্বকে।
বৃহস্পতিবার মমতার মন্ত্রিসভার বৈঠক পণ্ড করে পাহাড়ের মানুষের সামনে হিরো হওয়ার একটা সুযোগ তাঁর আছে বলেই মনে করছিলেন বিমল গুরুং।তাই পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই তিনি এদিনের কর্মসূচি সাজিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার দুপুর দু'টো থেকে যখন দার্জিলিং রাজভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক করবেন তখনই রাজভবনের বাইরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবেন মোর্চা নেতারা।এমনটাই ঠিক করে দিয়েছিলেন বিমল গুরুং।
সেইমতো এদিন মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই মিছিল করে এসে রাজভবনের কাছে জমায়েত হন মোর্চা সমর্থকরা। ৩০ জন মন্ত্রীকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প গ্রহণ করেন। যার মধ্যে ছিল পাহাড়ে সচিবালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা।মিরিকে পলিটেকনিক কলেজ-সহ আরও নানা প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়। দার্জিলিঙে রাজভবনের অন্দরে যখন রাজ্য মন্ত্রিসভা এমনসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, ঠিক তখনই মোর্চা নেতারা বিক্ষোভের আঁচ বাড়িয়েই চলেছিলেন। বিপুল জনতার বিক্ষোভ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে।
মোর্চা সমর্থকদের জঙ্গি আন্দোলনের মোকাবিলা র্যাফ, আধা সামরিক বাহিনী নামাতে হয়। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, এমনকী শূন্য গুলি চালাতে হয়। এই আন্দোলনের ফলে দীর্ঘক্ষণ রাজভবনে আটকে পড়তে হয় মন্ত্রীদের। শেষপর্যন্ত বিশাল পুলিশ বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী নামিয়ে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে সমতলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন মন্ত্রীরা।
গুরুঙ্গ-রা উপায় না দেখে পাহাড়ে বিভাজন তাস ফেলেছেন। ফের গোর্খ্যালান্ড দাবি তুলেছেন। জিটিএ ছাড়ারও হুমকি দিয়েছেন। তবু মমতার ডোন্ট কেয়ার মনোভাব। পাহাড় যে বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ তা বোঝাতেই তিনি ব্যস্ত। মমতার এই কৌশলে মোর্চা ঘোর বিপাকে পড়ে গিয়েছে। সেই অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্যই ফের ভরা পর্যটন মরশুমে পাহাড়ে অশান্তির বীজ বপন করার চেষ্টা করল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।
বিগত দশ বছরে সে অর্থে পাহাড়কে এত অশান্ত হতে দেখা যায়নি। মদন তামাং হত্যা ছাড়া বড় কোনও ঘটনাও ঘটেনি। সে অর্থে কোনও বড় আন্দোলও সংঘটিত করতে পারেননি বিমল গুরুঙ্গ। বারবার গোর্খাল্যান্ডের দাবি তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই আন্দোলন জমাট বাঁধতে পারেনি।বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলাতে শুরু করে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যাই বারবার দাবি করেছেন, এখন পাহাড় হাসছে। এদিনের হিংসা যে মমতার সেই দাবিকে খাটো করার একটা প্রয়াস তাতে কোনও দ্বিমত নেই। গুরুংরা পাহাড়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করতে তাই গোর্খা আন্দোলনের সেই পুরনো হিংসার পথকেই হাতিয়ার করল বলেই মনে করা হচ্ছে।
গুরুং-এর এই চাল নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কারণ, পাহাড়ের মানুষ গত কয়েক দশক ধরে যে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিল এখন সেই অভাব মিটেছে। পাহাড়ে গত কয়েক বছর ধরে বহু উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েছে রাজ্য সরকার। রাস্তা ভাল করা থেকে শুরু করে পানীয় জলের সঙ্কট মেটাতে দার্জিলিং এবং তার সংলগ্ন এলাকায় একাধিক প্রকল্প নিয়েছে রাজ্য সরকার।
এর অধিকাংশ প্রকল্পের কাজই শেষ হওয়ার পথে। এমনকী, পাহাড়ের ছোট ছোট জনজাতিগুলির জন্য পৃথক বোর্ড তৈরি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলতে গেলে, পাহাড়ের মানুষ আর চাইছেন না কোনও হিংসা বা আন্দোলনের শরিক হতে। এতে যে উন্নয়নের গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে তা তারা ভালোই জানেন। তাই গুরুং-এর গোর্খা আবেগে কতদিন পাহাড়ের মানুষ পাপেট ডল-এর ভূমিকা পালন করবে সে প্রশ্নও চারিদিকে গুঞ্জরিত হচ্ছে।