বিস্মৃতির পাতায় মানভূম জননী! স্বাধীনতা সংগ্রামী লাবণ্য প্রভার নাম কেউ মনে রেখেছেন আজ?
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট, তারিখটা সকলেরই জানা। সকল ভারতীয় এই দিন দেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করেন। স্কুল কলেজ হোক কিংবা পাড়ার ক্লাব, স্বাধীনতা দিবসের দিন সকাল বেলা দেখা যায় পতাকা উত্তোলনের ভিড়। প্রায় সকলের বাইক বা গাড়িতে লাগানো থাকে ছোট্ট তিরঙ্গা।
পতাকার তিনরঙা পোশাক পড়ে কাটে খুদেদের এক ছুটির দিন। এরপর জাতীয় সঙ্গীত, লজেন্স বিস্কুট, বা নানা রকমের সামাজিক কর্মসূচি পালইন করে কাটে গোটা দিন। বিকেল হলেই ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, অথবা পাড়ায় পিকনিক। মোটের উপর প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস পালনের চিত্রটা এভাবেই ধরা দেয় সকলের কাছে।
কিন্তু এই বিশেষ দিনে দেশের ১০জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম এক নিঃশ্বাসে বলতে গেলেই যেখানে হোঁচট খেতে হয় 'আধুনিক' ভারতের বহু নাগরিককে, সেখানে এখনও দেশের জন্য চরম আত্মবলীদানের বীরগাথা আগলে বসে রয়েছে বহু পুণ্যভূমি। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে একবার ফিরে দেখা যাক কালের অতলে ডুবে যাওয়া এমনই এক বীরাঙ্গনার সাতকাহন।
লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ
লাবন্য, শব্দের সঙ্গেই সামনে আসে অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী কোনও ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। নামের মতই অসামান্যা ছিলেন বাংলার এই বীর নারী। ১৮৯৭ সালের ১৪ অগাস্ট পুরুলিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন লাবণ্য প্রভা দেবী। পিতা ঋষি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ছোটবেলায় বাবার কাছেই শুরু হয় লাবণ্য প্রভার শিক্ষা গ্রহণ। এরপর সেদিনের সমাজের রীতি মেনে মাত্র ১১ বছর বয়সেই বিয়ে হয় বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুল চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে। কিন্তু নিছকই বঙ্গবঁধু হয়ে ঘরকন্নায় জীবন কাটানোর বিধিলিপি তাঁর কপআলে লিখে দাননি বিধাতা। কারণ বিয়ের পরেই শুরু হয় লাবণ্য প্রভা থেকে 'মানভূম জননী' হয়ে ওঠার যাত্রা।
গান্ধীবাদ ও লাবণ্য প্রভা
স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি লাবণ্য প্রভা দেবীর বাবা নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত দুই সাপ্তাহিক পত্রিকা 'মুক্তি'র প্রতিষ্ঠা করেন। এই পত্রিকাই ছিল লাবণ্য প্রভার প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হওয়ার দলিল। সেই সময় বাংলায় খুবই শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল এই পত্রিকা। স্বামী এবং বাবার হাত ধরেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অভিষেক হয়েছিল লাবণ্য প্রভা দেবীর। সেই সময়ই তাঁর মধ্যে তৈরি হয় রাজনৈতিক চেতনা, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হন পুরুলিয়ার এই রমণী। সেই সময় থেকেই মহাত্মা গান্ধীকেই নিজের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করার জন্য গ্রেফতার হন নিবারণ চন্দ্র। আর বাবার সেই সংকটময় সময়ে দেশকে দাসত্বমুক্ত করার যুদ্ধে সরাসরি যোগ দিলেন লাবণ্যপ্রভা। নিবারণ দাশগুপ্ত ও অতুলচন্দ্র ঘোষের মিলিত উদ্যোগে পুরুলিয়ার তেলকলপাড়ায় স্থাপিত হল শিল্পাশ্রম, অচিরেই যা হয়ে ওঠে বিপ্লবী ও জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের শক্ত ঘাঁটি। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ বহু জাতীয় নেতাদের উপস্থিত ধন্য ছিল শিল্পাশ্রমে। ধীরে ধীরে আন্দোলনের মূল স্রোতেও ঢুকে পড়লেন লাবণ্য প্রভা। স্থানীয় মানুষদের উন্নয়নের দিকেও খেয়াল ছিল তাঁর।
ভাষা বিপ্লবে লাবণ্য প্রভা দেবী
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি'। গানের কলির সঙ্গেই মনে পড়ে সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তে স্নান করা মুখ। কিন্তু ঢাকা নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন যে মানভূম ভাষা আন্দোলন, এই কথা আর কতজনই বা জানেন! আর সেই আন্দোলনে যিনি সকলের সামনে থেকে লড়াই করেছেন সেই বীরাঙ্গনার নাম লাবণ্য প্রভা ঘোষ। ১৯১২ সালে যে আন্দোলনের শুরু হয় এই আন্দোলন, যা চলে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সারা বঙ্গে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। বাংলা ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছিলেন লাবণ্য প্রভা দেবী। ২০০৩ সালে ভাষাশহীদ স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে সাম্মানিক পুরস্কার এই বীর নারীর হাতে তুলে দেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মানভূম জননীর ইতিকথা
প্রায় ২০০ বছরের দাসত্ব, অত্যাচার এবং লাখ লাখ বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অবশেষে ভারতে এল স্বাধীনতা। কাঁটাতারে দীর্ণ, রক্তাক্ত হলেও স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করলেন ভারতবাসী। কিন্তু সংকট যে কাটেনি, তা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন লাবণ্য। এতদিন বেশ ভালোই ছিল পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চল, যেখানে বাঙালি, আদিবাসী সবাই একসঙ্গে বেড়ে উঠছিল নিজেদের মতো করেই। হঠাৎ করে সেখানে শুরু হল অদৃশ্য চোখরাঙানি। জোর করে সেখানে হিন্দি ভাষা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা কিছুতেই মানতে পারলেন না লাবণ্য প্রভা দেবী। সেখান থেকেই পুরুলিয়া ও মানভূম অঞ্চলে শুরু হল আরেক ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর আন্দোলন। একবার নয়, তিনবার লাবণ্য প্রভাকে জেলবন্দী করে তৎকালীন বিহার সরকার। কিন্তু তিনি যে হারতে শেখেননি! তাই লাগাতার আগুন ঝড়ল 'মুক্তি'র পাতায়। অবশেষে সব দাবি মেনে ১৯৫৬ সালে বিহার থেকে আলাদা হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ল পুরুলিয়া। আর ভূমিকন্যা লাবণ্য প্রভা হয়ে উঠলেন 'মানভূম জননী'।
শেষের সেদিন
১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থার সময় পুনরায় রাজরোষে গ্রেফতার হন লাবণ্য প্রভা দেবী। তবে এরপরেই বিধায়ক হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু তার পরের জীবনের কাহিনি অবশ্যে বেশ সিমিত। অভাব আর বিস্মৃতির অতলে ক্রমেই ফিকে হয়ে যায় লাবণ্য প্রভা ঘোষের নাম। স্বাধীনতা সংগ্রামীর সামান্য পেনশনটুকু ছাড়া আর তেমন কিছুই সম্বল ছিলোনা তাঁর। একদিন যে মানুষের জন্য নিজের সবকিছু ত্যাগ করে দিয়েছেন অবলীলায়, কালের আবর্তে সেই মানুষের কাছেই হয়ে গিয়েছেন ব্রাত্য। কিন্তু লাবণ্য প্রভা দেবী মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারাননি কোনওদিন। ১০৬ বছরের জীবনের শেষ দিকে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল একটা চোখ। প্রাপ্য সম্মান তেমন পাননি এই বীরাঙ্গনা। ক্ষীণ দৃষ্টিতে কী লাবণ্য প্রভা দেখতে পেতেন তাঁর ছোট্ট বাড়ির উঠোনে প্রতিবার স্বাধীনতা দিবসে নীল আকাশে গর্ব ভরে উড়ছে দেশের জাতীয় পতাকা, আর সকলের মিলিত কণ্ঠে ভেসে আসছে সঠিক দেশপ্রেম ও বন্দে মাতরম রব? উত্তরটা আজও জানার চেষ্টা করেননি স্বাধীন ভারতের নাগরিকরা।
ছবি সৌজন্য পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন ওয়েবসাইট