দলিত, পাকিস্তান, মুসলমান - এতদিক সামলাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বেশ বিব্রতই মনে হচ্ছে
নরেন্দ্র মোদী কি ক্রমেই বিপর্যস্ত বোধ করছেন? কেরলের কোঝিকোড়ে বিজেপির পার্টি জাতীয় পরিষদীয় বৈঠকে শনিবার পাকিস্তান প্রসঙ্গে কৌশলগত 'লড়াই'-এর ডাক দিলেন। এরপর রবিবার জনসঙ্ঘের প্রয়াত তাত্ত্বিক নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের স্মরণে পরামর্শ দিলেন মুসলমানদের "নিজের লোক" হিসেবে দেখার। কংগ্রেসি জমানার ধর্মনিরপেক্ষতা ঘুরিয়ে খোঁটা দিয়েই বোঝাতে চাইলেন মুসলমানদের "নির্বাচনের বোড়ে" বানানো কোনও কাজের কথা নয়।
এর আগে অগাস্ট মাসে বেশ কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীকে দেখা গিয়েছিল দলিতদের হয়ে কথা বলতে এবং তাঁদের যে ক্রমাগত গো-রক্ষক বাহিনীর কাছে আক্রান্ত হতে হচ্ছে, সে ব্যাপারেও অসন্তোষ প্রকাশ করতে। হায়দরাবাদের এক জনসভায় মোদী বলেন: "আক্রমণ করতে হয়, গুলি করতে হয়, আমাকে করুন, দলিতদের রেহাই দিন।" [দোহাই, এই যুদ্ধের জিগির এবার বন্ধ করুন! পাকিস্তান ছাড়াও আমাদের অনেক কিছু ভাবার, করার আছে]
একজন ব্যক্তিকে বারবার কেন সবাইকে তাঁদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দিতে হবে?
মোদীর এই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে বারংবার তাঁর নিজের সমর্থকদের নানা বার্তা দেওয়া, এটি কিন্তু খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। যদি একজন ব্যক্তির উপরে দেশের সামগ্রিক ভালোমন্দ দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে, তবে বুঝতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির চাকা সম্পূর্ণরূপে ঘুরতে ব্যর্থ হচ্ছে, কোথাও তা আটকে যাচ্ছে।
একইসঙ্গে প্রশাসক, রাজনৈতিক এবং কূটনীতিকের কাঁটার মুকুট
এই যে নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে এক সাথে প্রশাসক, রাজনীতিক এবং কূটনীতিকের মুকুট পড়ে সবদিক সামলে চলতে হচ্ছে অনবরত, তাতে কি আদতে দেশের শাসনযন্ত্রের অতিরিক্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক দিকটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে না? কেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে "দলিতকে রেহাই দিন" বা "মুসলমানকে নিজের লোক বলে ভাবুন" কথাগুলি বলতে হবে? কেন মনে করিয়ে দিতে হবে যে তাঁর "সবকা সাথ, সবকা বিকাশ" স্লোগান আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলে, রাজনৈতিক স্বপ্নপূরণের কথা নয়?
এই তুমুল জাতীয়তাবাদী জিগিরের সময়ে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে
আসলে এই অতিজাতীয়তাবাদী জিগিরের সময়ে প্রশাসন-রাজধর্ম-দেশপ্রেম সবই যেন গুলিয়ে গিয়েছে। মুসলমানকে নিজের লোক ভাবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান-বিরোধী চিন্তাভাবনা। অন্যদিকে, গো-ভক্ষণের কারণেও মুসলমান বা দলিতদের সংখ্যাগুরুর পেশিশক্তির শিকার হতে হচ্ছে। দেশের ভিতরে ও বিদেশনীতিতে এক প্রবল নেতির ঝড়ঝঞ্ঝা চলেছে অহরহ।
মোদী সরকারের উন্নয়নের সমস্ত যজ্ঞ-কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তা যেন শুধু এদেশের বিপুল মধ্যবিত্তের কথা ভেবেই হচ্ছে। সেখানে মুসলমান বা দলিতদের উপর বারংবার আক্রমণের ঘটনা একধরনের 'এক্সক্লুসিভিস্ট' রাজনীতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। [প্রায় আড়াই বছর পরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উড়ান অব্যাহত; তবে এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই]
পাকিস্তান এবং মুসলমান নিয়ে মোদীর এই বার্তা কিন্তু সহজ কাজ নয়
এই সপ্তাহান্তে কোঝিকোড়ে মোদীর এই পাকিস্তান এবং মুসলমান সম্পর্কিত বার্তার মধ্যে দু'টি দিক রয়েছে। এক উরিকাণ্ডের পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশবাসীর মনে ফুটতে থাকা আবেগকে (মিডিয়ার দৌলতে যা আরও বাড়ে) প্রশমিত করা, আর দুই, দলীয় কর্মীদের মুসলমানকে "নিজের লোক ভাবতে" শেখানোর মাধ্যমে 'ইনক্লুসিভিস্ট' রাজনীতির আমদানি করার প্রয়াস। কাজটার মধ্যে ভারসাম্য রাখা মোটেও সহজ নয়। কারণ এর মধ্যে দিয়ে নিজের অদলীয় এবং দলীয় সমর্থকদের অসন্তুষ্ট করার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষ্য উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত
কিন্তু মোদী এই দুই স্পর্শকাতর বিষয়কে একই মঞ্চে উত্থাপন করলেন কেন? কারণ আর কিছুই নয়: আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাতের নির্বাচন।
এই দু'টি রাজ্যে মোদী এবং বিজেপির অনেক কিছুই হারানোর ভয় আছে। উত্তরপ্রদেশে ২০১৪-র ফলাফল যে ফ্লুক ছিল না, সেটা প্রমাণ করতে মোদী-অমিত শাহ জুড়িকে পরবর্তী উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে ভালো কিছু করে দেখাতেই হবে। কিন্তু সম্প্রতি দলিত নেত্রী মায়াবতীর প্রতি এক বিজেপি নেতার অমার্জিত ভাষা ব্যবহার এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দলিতদের উপর হয়ে চলা বেলাগাম আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি যে সুবিধাজনক নয়, তা বিজেপি নেতৃত্ব ভালোই বুঝছেন।
অন্যদিকে, মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতেও প্রায় দু'দশক ধরে ক্ষমতাসীন বিজেপি সম্প্রতি নানা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তা সে পতিদারদের বিক্ষোভ হোক বা দলিতদের উপর আক্রমণের সমালোচনা। আম আদমি পার্টিও এই সুযোগে মোদীর নিজের রাজ্যে বিজেপির পায়ের তোলা থেকে জমি কেড়ে নিতে তৎপর। বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকেও বদল করেছেন কৌশলগত কারণে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও গুজরাত নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে মোদী-শাহরা কতটা আত্মবিশ্বাসী, তা তাঁরাই জানেন।
বিব্রত প্রধানমন্ত্রী দীনদয়াল উপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হলেন?
তবে মোদীর এই দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মানবতাবাদী দর্শনের মাধ্যমে নিজের সমর্থনকে বাজিয়ে দেখানোর যে সূক্ষ রাজনীতি, তা একদিক থেকে প্রমাণ করে যে প্রধানমন্ত্রী মোটেই খুব একটা স্বস্তিতে নেই। তাঁর দল এবং সরকার আদতে তিনিই, সুতরাং দল এবং সরকার যদি বড় কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে (যেমন সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং পাকিস্তান সম্পর্কে সমালোচনা) তাহলে তার সম্পূর্ণ দায় তাঁর ঘাড়ে এসেই বর্তায়।
আর এদিক থেকে মোদীর কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর মতো মধ্যপন্থী দলীয় আদর্শ বা প্রাক-পরমাণু যুগের সুবিধাও নেই যে 'বাংলাদেশ যুদ্ধের' মতো একটি জাতীয়তাবাদী মাস্টারস্ট্রোকেই উনি খেলা ঘুরিয়ে দেবেন।