সফেদ পাহাড়ে ঘেরা পহেলগাঁও, যার পরতে পরতে রয়েছে সৌন্দর্য্য
গুলমার্গ ও সোনমার্গের সৌন্দর্য্যে বিভোর হৃদয় যখন আরও কিছু দেখতে চায়, ঠিক তখনই কেনারাম দা (ট্যুর অপারেটর) এসে জানালেন যে এবার আমাদের ডেস্টিনেশন পহেলগাঁও।
গুলমার্গ ও সোনমার্গের সৌন্দর্য্যে বিভোর হৃদয় যখন আরও কিছু দেখতে চায়, ঠিক তখনই কেনারাম দা (ট্যুর অপারেটর) এসে জানালেন যে এবার আমাদের ডেস্টিনেশন পহেলগাঁও। কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার অন্তর্গত এই স্থানের সৌন্দর্য্যের নাকি কোনও তুলনা হয় না। সেই সৌন্দর্য্য দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠল মন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন সকালের চা বিস্কুট খেয়ে রওনা দেওয়া হল পহেলগাম বা পহেলগাঁও-র উদ্দেশে।
যাত্রাপথে
শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁও-র দূরত্ব প্রায় ৯৭ কিলোমিটার। উচ্চতা ৭ হাজার ফুটের কাছাকাছি। যাত্রাপথের মূল আকর্ষণ আঁকাবাঁকা খরস্রোতা লিডার নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাহাড়ি শহর। এক বাঁকের মুখে গাড়ি দাঁড় করালেন প্রীতম সিং (গাড়ির চালক)। বেশ কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসে রইলাম আমরা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাইন, ফার, আখরোট, চিনার ও দেবদারুর বনে হারিয়ে গেলেন অনেকে। দরাজ গলায় আকাশ ভরা সূর্য তারা ধরলাম সমস্বরে। মুহূর্তে পাল্টে গেল পরিবেশ। ভাবুক হয়ে উঠল মন। গাড়ি ছুটল পাহাড়ি পথ বেয়ে অনেক দূরে।
লিডার যেন এই এলাকাকে আধা সামরিক বাহিনীর মতোই ঘিরে রেখেছে। পথিমধ্যে পেয়ে গেলাম আপেল বাগান। লাল হয়ে যাওয়া সেই উদ্যানে স্বপ্ন-সুখের নিরন্তর আনাগোনা। পাহাড়ের কোল বেয়ে সে রাজ্যে নেমে এসেছে ভালোবাসা। তারই পাশে সরষে ক্ষেতের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগিয়ে চলল আমাদের রথ। দূরে নীল আকাশের নিচে তুষারাবৃত পীরপাঞ্জাল শৃঙ্গ মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিল। অনুভব করলাম, এই তো সেই ভূস্বর্গ, যার বর্ণনা গল্পে শুনেছিলাম।
পহেলগাঁও-র অর্থ প্রথম গ্রাম। জোজিলা পাস অতিক্রম করে লাদাখ পার হয়ে অমরনাথ দর্শন করে কাশ্মীর যাওয়ার পথে এটিই প্রথম গ্রাম। সেই অনুযায়ী জায়গারও নাম। যদিও সবশেষে পহেলগাঁও-র দর্শনে এলাম আমরা। বরফে মোড়া শৃঙ্গগুলি দূর থেকে হাতছানি দেয় পর্যটকদের। তারই কোল ঘেঁষে মূল শহরে প্রবেশ করলাম আমরা। উঠলাম ঢালের মুখে সুদৃশ্য হোটেলে। তখন সন্ধ্যে নেমেছে সবে। চাঁদের আলোয় আলোকিত ধরণী। নিরিবিলি চারিপাশ। পাশের আস্তাবল থেকে ভেসে এল দুই সহিসের গান। ভাষা বোঝা দায়। তবু তাঁদেরই পাশে অমোঘ টানে বসে রইলাম আমরা কজন। কনকনে ঠান্ডায় গভীর হল রাত। উষ্ণতার খোঁজে লেপের নিচে নিদ্রা গেল আম বাঙালি।
ঘোরাঘুরি
কেনারাম দা-র কথা মতো প্রাতরাশ সেরে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম এলাকা পরিদর্শনে। মাঝে এক স্থানে গাড়ি দাঁড় করালেন চালক প্রীতম। একটা বাড়ির দিকে হাত তুলে দেখালেন যে সেখানেই নাকি হয়েছে রনবীর কাপুরের হিন্দি সিনেমা 'রকস্টার'র শ্যুটিং। কাশ্মীর কি কলি, জব তক হ্যায় জানের মতো অন্যান্য হিন্দি সিনেমার শ্যুটিং কোথায় হয়েছে তাও যাত্রাপথে আমাদের দেখালেন প্রীতম। কেউ কেউ তো সেসব স্থানে নেমে ছবিও তুললেন। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা পাইন, দেবদারু, ফ্লোরা, ফনায় মোড়া আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে প্রীতম প্রথম যেখানে গাড়ি দাঁড় করালেন, পহেলগাঁও থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সেই জায়গার নাম বেতাব ভ্যালি।
বেতাব ভ্যালি : কেনারাম দা জানালেন, ১৯৮৩ সালে নির্মিত সানি দেওল ও অমৃতা সিং অভিনীত হিন্দি সিনেমা 'বেতাব'-র শ্যুটিং হয়েছে ওই স্থানে। লিডার নদীর ধার বিশাল এলাকা শুধুমাত্র ওই সিনেমার জন্য সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে তা এখন রীতিমতো পার্ক। নদীর ধারে সুদৃশ্য গাছের সারি, আলো, সিমেন্টের রাস্তা, চেয়ার, কাঠের সেতু ওই স্থানের শোভা বাড়িয়েছে। হিমেল হাওয়া কানে মৃদু ঝাপটা মারতেই গুটিসুটি হল পরিবেশ।
অরু ভ্যালি : পহেলগাঁও থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ও লিডার নদী থেকে অনেকটা উচ্চতায় অবস্থিত অরু ভ্যালি আদতে একটি পাহাড়ে ও প্রকৃতি ঘেরা গ্রাম। এখানকার ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারি আলাদা রকম শোভা বর্ধন করে। এখান থেকেই কোলাহই হিমবাহ ও কারসার লেকে ট্রেকিং করতে যান পর্যটকরা।
কোলাহই হিমবাহ : পহেলগাঁও থেকে ২৬ ও সোনমার্গ থেকে ১৬ কিলোমিটার দুরে কোলাহই হিমবাহের মূল আকর্ষণ শ্বেত বরফে ঢাকা পাহাড় এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসা জলতরঙ্গ। দুর্গম হওয়ায় সেই স্থানটি বেশিরভাগ দিনই বন্ধ করে রাখা হয়। এই হিমবাহের নামেই এখানকার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের নামকরণ করা হয়েছে।
তারসার লেক : চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত তারসার শীতকালে সাদা বরফে ঢেকে যায়। পরে বরফ গলে গেলে এই লেকের সৌন্দর্য্য অন্যমাত্রায় পৌঁছয়। গ্রীষ্মকালে পরিযায়ী পাখিরা এই লেকে এসে ভিড় করে বলে জানালেন কেনারাম দা।
শেইখপোরা : প্রকৃতির কোল ঘেঁষা এই পার্বত্য গ্রামে পিকনিক করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
চন্দনওয়াড়ি : কাশ্মীর থেকে দুর্গম অমরনাথ যাওয়ার পথে চন্দনওয়াড়িতে বেস ক্যাম্প করে রাত কাটান পর্যটকরা। সেসব দেখে সেদিন হোটেলে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে যায়।
ফেরার পালা
পরের দিন সকালে প্রীতম সিং-র গাড়ি আপেল বাগান, সরষে ক্ষেত, সেনাবাহিনীর উদ্ধত রাইফেল ও নজরদারি পেরিয়ে আমাদের এনে দাঁড় করাল শ্রীনগরের শেখ আল-আলম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে বিকেলের ফ্লাইটে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাজধানী থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেসে ডেস্টিনেশন কলকাতা।
বরফে মোড়া সোনমার্গ থেকে গুলমার্গ, এক মায়াজালের নাম কাশ্মীর
(শেষ কিস্তি)