ফিরে দেখা ২০১৯ : নতুন সম্ভাবনার জন্ম রাজ্য-রাজনীতিতে, কড়া টক্কর মমতা-মোদীর
২০১৯ কি নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে! অন্তত লোকসভা নির্বাচন ফলাফল তেমনটাই ইঙ্গিত করছে। বাংলার রাজনৈতিক আকাশে মহা-উত্থান হয়েছে বিজেপির। এক লাফে দুই থেকে বেড়ে ১৮ হয়েছে। অঙ্কের বিচারে ন-গুণ সাফল্যের অধিকারী গেরুয়া শিবির। এই প্রথম দু-অঙ্কের ঘরে পৌঁছনো. তারপরই স্বপ্ন দেখা শুরু।

বিজেপির সম্ভাবনা
প্রথমেই আসা যাক বাংলার আকাশে প্রায় এক দশক ধরে ধ্রুবতারা হয়ে থাকা তৃণমূলরে হারিয়ে বিজেপি বাংলার ক্ষমতায় আসতে পারে কি না, তা নিয়ে আলোচনায়। এখন লোকসভার অঙ্ক যদি বিজেপির রাজয জয়ের মাপকাঠি হয়, তবে বলতে হবে অবশ্যই সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপির। কেননা লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রকাশ করে দিয়েছে তৃণমূলের সীমাবদ্ধতা। সেই সীমাবদ্ধতা ভেদ করে তৃণমূলের উঠে আসা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনই বিজেপির পক্ষেও কঠিন এই সাফল্য ধরে রাখা। তৃণমূল চেষ্টা করবেই দুর্বলতা কাটিয়ে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে। বিজেপির তাই বিকল্প পরিকল্পনা দরকার। তা যে এখনই নেই, দেখিয়ে দিয়েছে পরবর্তী উপনির্বাচনগুলির ফলাফল। তিন উপনির্বাচনেই হেরেছে বিজেপি। এমনকী খড়গপুর ও কালিয়াগঞ্জে বিপুল ভোটে এগিয়ে থেকেও তারা হেরেছে তৃণমূলের কাছে। ফলে স্পষ্ট যে দিল্লির ভোট আর বাংলার ভোট এক জিনিস নয়। বিজেপি যদি ভেবে থাকে বাংলার ভোটও মোদীর ছবি দেখিয়ে জিতে যাব, তাহলে মস্ত বড় ভুল হবে। বিকল্প মুখে দরকার বাংলার ভোটে জিততে। জাতীয় নির্বাচনে যেমন মোদীর বিকল্প খুঁজে পায়নি বিরোধীরা, তেমনই রাজ্যের ভোটে মমতার বিকল্প খুঁজে পাওয়াও বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ।

তৃণমূলের সম্ভাবনা
লোকসভা ভোটে ৪২-এ ৪২ স্লোগান তুলেছিল তৃণমূল। কিন্তু মোদী-ক্যারিশ্মায় তা সম্ভব তো হয়ইনি, বাস্তবে দেখা গিয়েছিল তৃণমূল সত্যিই হাফ হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের আসন সংখ্যা ৩৪ থেকে কমে হয়ে গিয়েছে ২২। আর ২২ হয়ে যাওয়াই শুধু নয়, ১২৫টিরও বেশি বিধানসভা আসনে বিজেপির তুলনায় তারা পিছিয়ে পড়ে। ৫০টির মতো আসনে তৃণমূল এগিয়ে ছিল যৎসামান্য ভোটে। এ থেকেই অক্সিজেন পায় বিজেপি। বিজেপি মনে করতে শুরু করে, ২০২১-এ জয়লাভ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তৃণমূল দুর্ধর্ষ কামব্যাক করে বুঝিয়ে দিয়েছে। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ তৃণমূল। তার প্রমাণ মিলেছে উপনির্বাচন গুলিতেই। তিন কেন্দ্রে উফনির্বাচন হয়েছে লোকসভা ভোটের পর। তার মধ্যে দুটি কেন্দ্র বিজেপির কাছ তেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। একটি ধরে রেখেছে। দিলীপ ঘোষ তাঁর নিজের আসনটি ধরে রাখতে পারেননি। সেই আসনে লোকসভা ভোটে ৪৭ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল বিজেপি, আর কালিয়াগঞ্জে বিজেপি এগিয়ে ছিল ৫৪ হাজার ভোটে। দুটি কেন্দ্রেই সব ব্যবধা মুছে ফেলে জয়লাভ করেছে তৃণমূল। করিমপুরেও তৃণমূল জয়ের ব্যবধান বাড়িয়ে নিয়েছে। এই অবস্থা তৃণমূল বুঝিয়ে দিয়েছে তারা এখনও বাংলা শেষ কথা।

কংগ্রেসের সম্ভাবনা
সরকারিভাবে কংগ্রেস রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হলেও, বাস্তবাকি অর্থেই কংগ্রেস এখন লড়ছে রাজ্যে অস্তত্ব বাঁচাতে। কংগ্রেস গোটা রাজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থাতেই নেই। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি জেলা ছাড়া কংগ্রেসের অস্তিত্ব এখন সংকটে। সত্য কথা বলতে অধীর চৌধুরীর মুর্শিদাবাদ ছাড়া কংগ্রেসের প্রাপ্তির জায়গা শূন্য। এছাড়া মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ও পুরুলিয়ায় কিছু আসন পেতে পারে কংগ্রেস। তাই উত্তরদিনাজপুরের হাল শোচনীয় বলেই দেখিয়ে দিয়েছে লোকসভার ফল। যদিও এটা রাজ্যের নির্বাচন। এই নির্বাচনে কংগ্রেস কী করে সেটা দেখার। তবুও বলে দেওয়াই যায়, কংগ্রেস এই মুহূর্তে এককভাবে লড়াই দেওয়ার জায়গায় নেই। এমনকী বামেদের সঙ্গে জোট করেও তারা লড়াই দিতে পারবে বলে অন্তত মনে হয় না লোকসভা ফলাফল দেখে। কেননা, বাম-কংগ্রেসের ভোট-ব্যাঙ্ক ভাঙন ধরেছে। বেশিরভাগটাই চলে গিয়েছে বিজেপির দিকে, কংগ্রেসের ভোট বেশ কিছু গিয়েছে তৃণমূলের দিকেও। তাই কংগ্রেসের সম্ভাবনা ২০২৯-এর শেষে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে, একথা বলাই যায়। তবে কংগ্রেস তিন-চারটি জেলায় যে লড়াই দেবে, সেকথা বলা যেতেই পারে। কংগ্রেস চাইছে বামেদের সঙ্গে নিয়ে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে। এবং তৃণমূল ও বিজেপি শিবিরে লড়াইটা পৌঁছে দিতে।

বামফ্রন্টের সম্ভাবনা
৩৪ বছর শাসন চালিয়েছে এই বাংলায়। কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর মাত্র আট বছরেই সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে অস্তিত্বের লড়াই লড়তে হচ্ছে। প্রথম তৃণমূল সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিধানসভা ভোট পর্যন্ত তবু বামফ্রণ্ট লড়াইয়ের জায়গায় ছিল। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০১৯- এই তিন বছরে তা ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে তৃণমূলকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল তারা। যদিও নির্বাচনের ফলাফ সামনে আসার পর আক্ষরিক অর্থেই বাম-কংগ্রেস জোটের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবুও তারা ছিল। কিন্তু বিগত তিন বছরে কমতে কমতে, এখন একেবারে শেষের পথে। এখন রাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে নেমেছে তারা। কংগ্রেস তবু কয়েকটি জেলায় বেশ শক্তিশালী। সেখানে তারা জয়লাভের অবস্থাতেও রয়েছে, কিন্তু সিপিএম বা বামফ্রন্টের সেই জায়গাটে প্রায় নেই। এই অবস্থায় বামফ্রন্টের লড়াই খুব কঠিন। বামেদের ভোটে বিজেপি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। লোকসভার ভোট-ফলে তা প্রকট হয়ে উঠেছে। সেই ভোটব্যাঙ্ক ফিরে আসার কোনও পরিস্থিতি এখনও রাজ্য-রাজনীতিতে তৈরি হয়নি।