জাতীয় পতাকায় কোনও দেশ বেগুনি রঙ ব্যবহার করে না, কিন্তু কেন জানেন?
জাতীয় পতাকায় কোনও দেশ বেগুনি রঙ ব্যবহার করে না, কিন্তু কেন জানেন?
বিশ্বে ১৯৫টি দেশ রয়েছে, যাদের জাতীয় পতাকায় বেগুনি রঙের কোনও চিহ্নও নেই। কিন্তু কেন? কেন সব রং থাকলেও বেগুনি রং ব্রাত্য! এই বেগুনি রং-কে কি জাতির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যথেষ্ট যোগ্য রং বলে বিবেচিত করা হয় না? নাকি কোনও জাতি তাদের জাতীয় পতাকায় বেগুনি রঙ করেনি, তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে?
জাতীয় পতাকায় অপ্রতুল বেগুনি রঙ
বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন এবং ডিজাইন আমরা দেখতে পাই। কেউ কেউ কমলা এবং হলুদের মতো উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেছেন আবার কেউ কেউ তাদের মধ্যে তারা এবং ড্রাগন রেখেছেন। কিন্তু জাতীয় পতাকার কোনওটিতেই বেগুনি রঙ দেখা যায় না প্রায়।
জাতীয় পতাকায় বেগুনি রং থাকে না
কেন বেগুনি রং ব্যবহার করা হয় না, তার একাধিক তাত্ত্বিক কারণ আছে। তার মধ্যে একটি হল যে, বেগুনি রং মূলত রাজতন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল এবং বিশ্ব যখন প্রজাতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশগুলির জন্য তাদের জাতীয় পতাকায় বেগুনি রং অন্তর্ভুক্ত করা উপযুক্ত বলে মনে করেননি কেউ। সেই ধারা চলে এসেছে।
বেগুনি রং না ব্যবহার করার মূল কারণ
কিন্তু তা তো একটা 'তত্ত্ব' মাত্র। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, বেগুনি রং না ব্যবহার করার মূল কারণটি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাধারণত যে সমস্যার মুখোমুখি হয়, তার সাথে খুব মিল এই রং না ব্যবহারের। কারণ তখনকার দিনে বেগুনি কাপড়ের দাম ছিল অত্যন্ত। ফলে দেশগুলো তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করতে পারত না!
ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হত বেগুনি রংকে
বেগুনি রং-এর মধ্যে রয়্যালটির বিষয় রয়ে গিয়েছে সর্বদা। বেগুনি রঙের চারপাশে একটি রাজত্বের গন্ধ লুকিয়ে থাকত। এবং এটিকে রয়্যাল বেগুনি হিসাবে উল্লেখ করা হত। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এটি এত ব্যয়বহুল ছিল যে শুধুমাত্র অতি ধনী এবং রাজপরিবারের লোকেরাই রঙটি সাজাতে পারত। তাই একে ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হত।
বেগুনি রং নিয়ে রয়েছে একটি মজার ঘটনা
এই বেগুনি রং নিয়ে একটি মজার ঘটনাও রয়েছে। রানি ভিক্টোরিয়া প্রথম জনগণের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু নিয়ম নয়, তা একেবারে আইনে পরিণত করেছিলেন তিনি। আক্ষরিক অর্থে রাজপরিবার ব্যতীত অন্য কাউকে বেগুনি পরতে নিষেধ করা হয়েছিল সেই আইনে।
সামুদ্রিক শামুক থেকে তৈরি হত বেগুনি রঙ
কিন্তু এই রং অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণ কী, কারণ এটি ছিল বিরল এবং এটি উৎপাদন করা যেত একমাত্র প্রাকৃতিকভাবে। বেগুনি রঙের উৎপত্তি ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত প্রাচীন ফিনিশিয়ান শহর টায়ারে। বর্তমানে তা লেবাননে অবস্থিত। টায়ারের লোকেরা সেই অঞ্চলে স্পাইনি ডাই-মিউরেক্স নামে পরিচিত একটি সামুদ্রিক শামুক থেকে বেগুনি রঙ তৈরি করত।
সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসতেই ঘটেছিল জাদুকরী
সমুদ্রের তীরে হাজার হাজার সামুদ্রিক শামুক পাওয়া যেত। এই বেগুনি রং তৈরির প্রক্রিয়াটি শুরু হত সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকা থেকে। তাদের খোলস ফাটানোর পরই শামুকের গ্রন্থি থেকে পাতলা শ্লেষ্মা বের করা হয়, সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসার পর, যা ঘটেছিল তা জাদুকরীর থেকে কম নয়।
সোনার থেকেও বেশি ব্যয়বহুল ছিল বেগুনি রং
সূর্যের আলোতে ওই শ্লেষ্মা মিউকাস সাদা, তারপর হলুদ-সবুজ, তারপর লাল এবং অবশেষে একটি গভীর, প্রাণবন্ত বেগুনি রঙ প্রাপ্ত হয়। এই বেগুনি রঞ্জক টাইরিয়ান বেগুনি নামে পরিচিত ছিল। প্রক্রিয়াটি খুব সময়সাপেক্ষ এবং শ্রম নিবিড় ছিল। এর উপরে প্রায় হাজার হাজার শামুকের প্রয়োজন ছিল মাত্র এক গ্রাম রঞ্জক তৈরি করতে। ফলস্বরূপ তা সোনার থেকেও বেশি ব্যয়বহুল ছিল।
বেগুনি রং-এ মিরাকেল ঘটিয়েছিলেন রসায়নবিদ
বেগুনি দামী ছিল, কিন্তু এখন তা নয়। এবং এর কৃতিত্ব ইংরেজ রসায়নবিদ উইলিয়াম হেনরি পারকিনের। ১৮৫৬ সালে দুর্ঘটনাক্রমে বেগুনি রঞ্জক তৈরির সিন্থেটিক উপায় আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। মাত্র আঠারো বছর বয়সী রসায়নের ছাত্র উইলিয়াম হেনরি তাক লাগিয়ে দেন এই আবিষ্কারে।
কুইনাইন তৈরি করতে গিয়ে তৈরি হল বেগুনি রং
তিনি আসলে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত সিন্থেটিক কুইনাইন তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তে বেগুনি রং তৈরি করে। তিনি বেগুনি রঞ্জক তৈরির এই কৃত্রিম পদ্ধতির পেটেন্ট হয়ে গিয়েছিলেন, একটি কারখানা তৈরি করেছিলেন। এবং প্রচুর পরিমাণে রাজকীয় রঙ তৈরি করতে শুরু করেছিলেন।
বেগুনি রং এখনও জাতীয় পতাকায় দেখা যায় না কেন?
তাহলে কেন বেগুনি রং এখনও জাতীয় পতাকায় দেখা যায় না? দুঃখের বিষয়, যদিও রঙটি ১৯০০ সালের পরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন বিভিন্ন দেশের বেশিরভাগ জাতীয় পতাকা ডিজাইন করা হয়ে গিয়েছিল এবং তা পরে আর পরিবর্তন করা হয়নি। শুধুমাত্র একটি দেশ ডোমিনিকা যারা আধুনিক পতাকা তৈরি করেছিল। ১৯৭৮ সালে গৃহীত ওই জাতীয় পতাকায় বেগুনি রঙের একটি ইঙ্গিত রয়েছে। শুধুই ইঙ্গিত!