কালামজীর প্রয়াণে ভারত একজন রত্নকে হারাল : নরেন্দ্র মোদী
ভারত একজন রত্নকে হারাল। তবে এই মানিক থেকে ঠিকরে বেরনো দ্যুতি আমাদের এপিজে আব্দুল কালামের স্বপ্নের গন্তব্যে নিয়ে যেতে পথপ্রদর্শকের কাজ করবে। ভারতবর্ষ জ্ঞানের ভাণ্ডার, পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। আমাদের বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রপতি, এপিজে আব্দুল কালাম এমন একজন মানুষ যিনি গোটা দেশের মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। এমন একজন যিনি কখনও পার্থিব সাফল্যকে মাপকাঠি হিসাবে ধরেননি।
তিনি বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বিশ্বাস করতেন, দারিদ্রকে মোকাবিলা করা সম্ভব একমাত্র জ্ঞানের ভাণ্ডার দিয়ে। আমাদের প্রতিরক্ষা প্রকল্পের নায়ক হিসাবে উনি চিন্তাভাবনার সীমাকেই পাল্টে দিয়েছিলেন। তাঁর মুক্ত চিন্তাধারা সংকীর্ণ ভাবনাগুলিকে বদলে দিয়ে এক মৈত্রীর আবহ তৈরি করেছিল।
প্রত্যকটি মহান জীবনই একটি প্রিজমের মতো। সেটা থেকে ঠিকরে বেরনো আলোয় আমাদের দিকে ধাবিত হয় এবং আমরা তাতে স্নাত হই। আব্দুল কালামের ভাবাদর্শ সুরক্ষিত কারণ তা সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি শিশুর বঞ্চনায় বাস্তবতা রয়েছে। দারিদ্রতা কখনও বিভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দেয় না। দারিদ্রতা এমনই একটি ভীষণ দায়; যা একটি শিশুকে স্বপ্ন দেখার আগেই তা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
তবে কালামজী পরিস্থিতির কাছে হার মানতে রাজি ছিলেন না। বালক বয়সেই নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে তিনি সংবাদপত্র বিলিয়েছেন। আর আজ সেই সংবাদপত্রগুলিই পাতার পর পাতা তাঁর মৃত্যু সংবাদে পূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, তিনি অতটাও বেয়াদপ নন যে বলবেন, "আমার জীবন কারও আদর্শ হবে।" তবে কোনও গরিব শিশু যদি অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে, সমাজের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে কালাম সাহেবের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারে। একইসঙ্গে তাঁর জীবন সেই সকল শিশুদের সমাজে পিছিয়ে পড়া বা অসহায়তা নামের মরীচিকা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। তাই তিনি আমার পথপ্রদর্শক, একইসঙ্গে সেই সকল শিশুরও পথপ্রদর্শক এই মানুষটি।
কালাম সাহেবের চরিত্র, দায়বদ্ধতা, অনুপ্রেরণামূলক দূরদৃষ্টি সারাজীবন তাঁর সঙ্গী থেকেছে। তাঁর অহংবর্জিত মনন; তাঁকে স্থিতধী করেছে। জনগণ হোক অথবা রাষ্ট্রনেতা অথবা একঘর ছাত্র, সবার সামনেই তিনি একইরকমভাবে শান্ত থাকতে পারতেন। তাঁর কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে কথা মনে আসে তা হল, তাঁর মধ্যে একইসঙ্গে শিশুমনের সততা ছিল, কিশোর বয়সীদের স্ফূর্তি ছিল, এবং একইসঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পরিপক্কতা ছিল। তিনি সমাজ থেকে খুবই যৎসামান্য নিয়েছেন, আর যতভাবে সম্ভব, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। সবকিছুতেই গভীর বিশ্বাস রাখা এই মানুষটি সভ্যতা সবচেয়ে মহৎ তিনটি গুণকে সংক্ষেপে তুলে ধরেন :- আত্ম-সংযম, আত্মোৎসর্গ ও সহানুভূতি।
তবে এই মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে উদ্যমের কোনও খামতি ছিল না। দেশের জন্য তাঁর দূরদৃষ্টির ভিত্তি ছিল স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও শক্তি। স্বাধীনতার একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল নিশ্চয়ই; তবে মনের স্বাধীনতা এবং বুদ্ধিমত্তাও তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি চাইতেন, অর্থনৈতিক সুবৃদ্ধি হয়ে ভারত অনগ্রসরতা থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে আসুক এবং দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক।
তিনি পরামর্শ দেন, রাজনীতিবিদেরা নিজেদের সময়ের মাত্র ৩০ শতাংশ রাজনীতিতে ব্যয় করেন, এবং ৭০ শতাংশ উন্নয়নে। এবং এই বিষয়টিকে বাস্তব রূপ দিতে তিনি প্রায়শই বিভিন্ন রাজ্যের সাংসদদের ডেকে এনে সেখানকার আর্থ-সামাজিক বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। তিনি মনে করতেন, আগ্রাসন কখনও শক্তির জন্ম দেয় না, বরং তা আসে উপলব্ধি থেকে। নিরাপত্তাহীন একটি রাষ্ট্র কখনও উন্নতির পথে চলতে পারে না।
পারমাণবিক ও মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে কালামজীর অবদান ভারতকে আঞ্চলিক স্তরে ও বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্টিত করেছে। তাঁর তৈরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্মন্ধীয় প্রতিষ্ঠানগুলিই তাঁর স্মৃতি বহন করছে। একইসঙ্গে তা আমাদের প্রকৃতির অসীম শক্তিকে নিজেদের হিতে কাজে লাগাতে সাহায্য করেছে। বেশিরভাগ সময়ই, আমাদের লোলুপতা প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। তবে কালামজী গাছের মধ্যেও কবিতা কল্পনা করেছেন, জল, বাতাস, সূর্যের মধ্যে শক্তিকে খুঁজে পেয়েছেন। তাই তাঁর চোখ দিয়েই আমাদের গোটা বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত, ঠিক একইরকম দূরদৃষ্টি ও আবেগপূর্ণ উৎসাহ নিয়ে।
মানুষ ইচ্ছা, অধ্যাবসায়, যোগ্যতা ও মনের সাহস দিয়ে নিজের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে পারে। তবে কোথায় আমরা জন্মেছি অথবা কোথায়, কীভাবে আমাদের মৃত্যু হবে তা জানতে পারি না। তবে যদি কালামজীকে সুযোগ দেওয়া হতো, নিজের ইচ্ছায় চিরবিদায় নেওয়ার, তাহলে এভাবেই এক ক্লাসরুম ভর্তি ছাত্রছাত্রীর সামনে তিনি বিদায় নিতে চাইতেন।
অবিবাহিত বলে তাঁর কোনও সন্তান ছিল না। একথা সর্বাগ্রে ভুল। প্রতিটি ভারতীয় শিশুর জনক ছিলেন তিনি। যেখানে যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন, অন্ধকার দূর করে শিক্ষার আলোকে ভরিয়ে দিয়েছেন সবাইকে নিজের দূরদৃষ্টি দিয়ে। তিনি ভবিষ্যতকে চাক্ষুষ করেছিলেন এবং সবাইকে সেইমতো পথনির্দেশও করেন।
তাঁর পার্থিব দেহ যে ঘরে শায়িত ছিল, আমি যখন সেখানে প্রবেশ করলাম, আমি একটি ছবি দেখলাম। সেটাতে ছোটদের জন্য লেখা কালামজীর অনুপ্রেরণামূলক বইয়ের কয়েকটি লাইন লেখা ছিল। যেসকল ভালো কাজ তিনি সারাজীবনে করে গিয়েছেন, তা তাঁর প্রয়াণের সঙ্গেই বিদায় নেবে না। তাঁর প্রিয় ছেলে-মেয়েরা সারাজীবন নিজেদের কর্মের মধ্যে দিয়ে তাকে প্রজ্জ্বলিত করে রাখবে এবং তাদের ছেলে-মেয়েকে উপহার হিসাবে দান করে যাবে। [http://www.narendramodi.in/pm-modi-writes-on-apj-abdul-kalam]
নরেন্দ্র মোদী