গহীন অরণ্যের মাঝে, ডুয়ার্সের জঙ্গলে কয়েকদিন
বঙ্গের ভাণ্ডারে বিবিধ রতন। সেই রতনের টানে বেরিয়ে পড়া বাঙালি চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট। গুণ বললেই বা ক্ষতি কী! সেই গুণের ভাগীদার আমরাও।
বঙ্গের ভাণ্ডারে বিবিধ রতন। সেই রতনের টানে বেরিয়ে পড়া বাঙালি চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। গুণ বললেই বা ক্ষতি কী! সেই গুণের ভাগীদার আমরাও।
আমরা মানে আমি ও আমাদের গ্যাং। যাদের কর্মব্যস্ত নিষ্ঠুর জীবন থেকে অবকাশ শব্দের অবলুপ্তি ঘটেছে কবে কে জানে! তাই মন উড়ে যেতে চায়। তা বলে উঠল বাই তো কটক যাই করলেই তো হল না, দলবদ্ধ ভ্রমণের হ্যাপা সামলানোও কি মুখের কথা! যার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ, সময়োপযোগী পরিকল্পনার সঠিক রূপায়ণ। আর তা করতেই কমবেশি দম আটকে যাওয়ার জোগাড়। ওর ওমুক দিনে হলেও তার তমুক দিনে হলে সুবিধা। সর্বজন স্বীকৃত কোনও সময় যাও বা ঠিক হল, ট্যুরের পরিধি নিয়ে শুরু হয় তর্ক। এভাবেই কেটে যায় দিন, তারপর মাস। পরিকল্পনা চলে যায় ঘানিতে, সরিষার তেল টানিতে।
তবু কী জানি কীভাবে কোনও এক শুভ সন্ধিক্ষণে মিলে গেল সব শর্মার সময়। তা বলে বেশি দিনের ঝক্কি নয়। অগত্যা ঠিক হল কাছেপিঠে ডুয়ার্স থেকেই ঘুরে আসা যাক। শুধু গেলেই তো হল না, তার জন্য ট্রেনের রিজার্ভেশন থেকে হোটেল ও গাড়ি বুকিং, সর্বোপরি ভ্রমণসূচি তৈরি করা কী মুখের কথা! এত কম নোটিশে সব কাজ সুষ্টুভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে সর্বসম্মতিক্রমে দায়িত্বের সমবণ্টন করা হল। হোটেল ও গাড়ি যাও বা ঠিক হল, বেঁকে বসলো ভারতীয় রেল। সিট কনফার্ম তো দূর, আরএসি-তেও মাথা গলানোর ঠাঁই নেই।
কাল বিলম্ব না করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত নৈশকালীন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস পরিষেবাকেই আঁকড়ে ধরলাম। আর তারপর, 'ডে লা গ্রান্দে মাফিস্টোফেলেস! ইয়াক ইয়াক!' গোছের উন্মদনা নিয়ে বেরিয়ে পড়া জীবনের সন্ধানে।
বাই বাই কলকাতা
আমরা সবাই মিলিত হলাম ধর্মতলায়। রাত আটটায় ছাড়ল বাস। অলি-গলি-পাকস্থলী-রাজপথ পেরিয়ে ছুটে চললাম নিরুদ্দেশে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হল শহুরে জীবন। এবার মেঠো হওয়ার পালা। রাতে জাতীয় সড়কের ধারে অচেনা কোনও লঙ্গরখানায় (ধাবা বললেও ভুল হবে না) থামল বাস। কনডাক্টর বললেন, এক ঘণ্টার বেশি সেখানে দাঁড়াবে না তাঁদের যন্ত্রযান। তাই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম দ্রুততার সঙ্গে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওই হল্ট কৃষ্ণনগরেরই বর্ধিত অংশ। নিকষ কালো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অকারণ গল্পে মশগুল ছিলাম আমরা কজন। আচমকাই বাসের কর্কশ আর্তনাদে কিছু লহমার অযান্ত্রিক জীবনে যানজটে অস্থিরতা সুলভ চেনা সম্বিত ফেরে। বুঝলাম, প্রকৃতির কোলে নিরুদ্দেশ হতে এখনও ঢের দেরি। সেই ক্ষণের অপেক্ষায় চোখ বুঝলাম। আপন খেয়ালে ছুটে চলল বাস।
প্রথম দিন
শিলিগুড়ি থেকে সেবক হয়ে পার্বত্য রাস্তা ভেঙেছে দুটি ভাগে। একটি উঠেছে খাড়াইয়ের দিকে এবং অন্যটি নেমেছে তরাইয়ের বুকে। তিস্তাকে সাক্ষী রেখে দ্বিতীয় রাস্তাটি ধরে এগিয়ে চলল আমাদের বাস। প্রথম ডেস্টিনেশন জলপাইগুড়ির নিউ মালে পৌঁছতেই বেজে গেল বেলা বারোটা। গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন হোম স্টে-র মালিক। আমাদের অপেক্ষায় গাড়ি নিয়ে বাস স্ট্যান্ডেই অপেক্ষা করছিলেন চালক স্বপন। চালসা হয়ে মূর্তি নদীর ধারে রাহুতবাটিতে পৌঁছতে সময় লাগল পাক্কা ৩৫ মিনিট। গাছ-গাছালি, বাগানে ঘেরা হোম স্টে-র মালিক পরিমল দা আমাদের স্বাগত জানালেন।
ফরেস্ট বাংলোর মতোই ছায়া সুনিবিড় দুটি ঘর আমাদের জন্য ধার্য হল। স্নান, খাওয়া-দাওয়া (মাছ-মাংস, আলু ভাজা, কাগজি লেবু দিয়ে পাতলা মুসুর ডাল সহযোগে বাঙালি ঘরোয়া রান্না) সেরে মৃদুভাষী স্বপনের গাড়িতেই রওনা হলাম চাপড়ামারি অভয়ারণ্যের পথে। সেখানে ঢোকার টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল। জঙ্গলেরই মধ্যে তৈরি করা বাংলো থেকে থেকে নাকি হাতি, বাইসন, হরিণ, ময়ূর দেখা যায় হামেশা। কপাল সঙ্গ দিলে নাকি যাত্রাপথে দেখা যায় গণ্ডারও।
গরুমারা অভয়ারণ্য থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে চাপড়ামারি জঙ্গলে তৈরি বাংলোর অদূরে কাঁটাতারে ঘেরা এক স্থানে রয়েছে সুবিশাল ডোবা। সেখানে জল, ঘাস ও নুন খেতে আসে বন্যপ্রাণীর দল। বাংলোর সামনের ওয়াচ টাওয়ার থেকে চুপচাপ লক্ষ্য করা যায় জন্তুদের কর্ম পদ্ধতি। যদিও নিশ্চুপ নিরিবিলি ওই অভয়ারণ্যে সেদিন কয়েক পাল হরিণ ছাড়া আর কিছুই বাইনোকুলারে ধরা দিল না। সন্ধ্যে নামার আগেই সুন্দরী-গরাণ-গেঁও-ইউক্যালিপটাসের বন ভেদ করে হোম স্টে-তে ফিরে এল আমাদের গাড়ি। রুটি, বেগুন ভাজা ও বন মুরগির ঝোল সহযোগে সেদিনের নিঝুম রাতে যবনিকা পড়ল।
দ্বিতীয় দিন
ভোর ছটায় ঘুম থেকে উঠে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। ব্রেকফার্স্ট সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ঠিক সাতটায় রওনা হলাম। ডেস্টিনেশন সামসিং।
মূর্তি নদীর ধার ঘেঁষে নিঝুম উপত্যকা, চা বাগান ও কমলা লেবুর বনের মাঝখান দিয়ে বাঁক নেওয়া রাস্তায় সঙ্গী হল টিনের চালা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট বাড়ি। শাল-সেগুনে ভরা জঙ্গলের নাতিদূরে ধাপ চাষের শোভা যেন ওই এলাকার গয়না। এমন সৌন্দর্য্যে আত্মসমর্পণ যে করতেই হয়। পাহাড়ের রূপ যদি হয় স্বর্গোদ্যান, সেই স্বর্গের দ্বারও বা কম কীসে! সে রূপে বিমোহিত হয়ে আমরা সমস্বরে গান ধরলাম।
যাত্রাপথে গাড়িতেই সাবাড় করলাম গরম গরম লুচি, ছোলার ডাল ও মিস্টি। সকাল সাড়ে দশটায় স্বপন যেখানে গাড়ি থামালেন, চা বাগানে ঘেরা সেই এলাকার নাম লালিগুরাস। পাহাড়ের ঢালে মূর্তি নদীতে বেষ্টিত ওই স্থান চড়ুইভাতির জন্য প্রসিদ্ধ। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে সামসিং থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে সুনতালেখোলার দিকে রওনা হল আমাদের গাড়ি।
সুনতালিখোলা কটেজে বুকিং না থাকায় তিন কিলোমিটার আগে গাড়ি থামিয়ে হেটেই মূর্তির নদীর ধার পর্যন্ত পৌঁছনো গেল। কলকল শব্দে বয়ে চলা নদীকে ঘিরে রাখা ছোট টিলার মতো সবুজ পাহাড়, তারই গা-ঘেঁষে সবুজ গাছের জঙ্গল ওই এলাকার শোভা বাড়ায়। নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ সুনতালিখোলার মুখ্য আকর্ষণ। এবার কোথায়? 'রকি আইল্যান্ড যাবো দাদা', স্টিয়ারিং হাতেই উত্তর দিলেন চালক স্বপন।
সুনতালেখোলা থেকে সামসিং যাওয়ার পথে ডান দিকে পাথরে বাঁধানো রাস্তা চলে গিয়েছে রকি আইল্যান্ডের দিকে। খয়েরি পাহাড়ের কোলে বড় বড় পাথর উপচে বয়ে চলা সেই মূর্তি নদী অপরূপ সৌন্দ্যর্যের ধারক ও বাহক। পাশেই কমলা লেবুর বাগান, কুমাই টি এস্টেট সেই সৌন্দ্যর্যের নিরবিচ্ছিন্ন পাহারাদার। তারই নিচে এক মস্ত পাথরে পা ঝুলিয়ে সেরে নিলাম লাঞ্চ।
ঝালং-বিন্দু
রকি আইল্যান্ডকে পিছনে রেখে চাপড়ামারি অভয়ারণ্যের হৃদয় ধরে সিপচু হয়ে আগুয়ান পিচের রাস্তার গন্তব্য ঝালং। সেই রাস্তায় নাকি কখনও-সখনও গজরাজদেরও দেখা মেলে। তাই সন্তর্পণে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে কোনও কসুর করছিলেন না স্বপন। একই সঙ্গে তিনি জানালেন, জলঢাকা নদীকে বেঁধে ১৯৫৫ সালে তৈরি করা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখতেই ঝালংয়ে যান পর্যটকরা। নদী, সুদূর বিস্তৃত জঙ্গল, পাহাড় ও মেঘ দিয়ে ঢাকা যন্ত্র সভ্যতার এই অদ্ভুত নিদর্শন শুধু ভারত নয়, ভূটানকেও আলো দেয়। রাজার মতোই তার দম্ভ। এহেন সাম্রাজ্যকে অক্ষত রাখতে আশেপাশে মোতায়েন রয়েছেন সীমা সুরক্ষা বলের জওয়ানরা। ড্যামের নিকটে যাওয়া বারণ। তবু যতটা সম্ভব নিচে নেমে পাথরে বসে সেলফি, গ্রুপফি তোলা হল দেদার।
সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ভারত-ভূটান সীমান্তবর্তী বিন্দু গ্রামের শোভা ভূ-ভারতে দুর্লভ। সেখানেই এক কমলালেবুর বনে কিছু সময় জিরিয়ে নিলাম। সঙ্গে চলল গান, গল্প, আড্ডা, চায়ের তুফান। স্বপন জানালেন, এবার হোম স্টে-তে ফেরার পালা।
(প্রথম কিস্তি)
[আরও পড়ুন:উটির পরিবেশ সারা বছরই মনোরম! নীলগিরি অরণ্যের এই নগরী মুগ্ধ করতে বাধ্য]
[আরও পড়ুন:বৃষ্টিভেজা 'সবুজ' কেরলে এই বর্ষাতেই ঘুরে আসুন! রইল মন মাতানো কিছু জায়গার হদিশ]