দুর্নীতি ও ছাত্র পেটানোর অভিযুক্ত শিক্ষককে পাশে নিয়েই ময়দানে স্কুল পরিদর্শক, ভাইরাল হল ছবি
দুর্নীতি আর অনিয়মের বেড়াজালে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার হাল কতটা বেহাল তার ছবিটা বারবারই ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি তুলে ধরছে।
দুর্নীতি আর অনিয়মের বেড়াজালে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার হাল কতটা বেহাল তার ছবিটা বারবারই ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি তুলে ধরছে। উত্তর ২৪ পরগনার বরাহনগর সার্কেলে কীভাবে একটি স্কুলে সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনিয়ম জাকিয়ে বসেছিল তার ছবিও তুলে ধরে এই সংবাদমাধ্যম। এমনকী, জেলাশাসকের নির্দেশে জারি হওয়া তদন্তের শুনানিতেও যে অভিযুক্ত শিক্ষক নিজের দোষ স্বীকার করে নেন তাঁকে দিয়েই আবার সরকারি সমস্ত কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।
চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন সরিয়ে রাজ্যর মুখ্যমন্ত্রী পদে আসিন হয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় যে কোনও ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। শিক্ষায় যে কোনওভাবেই কোনও দুর্নীতি বা অনিয়ম তিনি বরদাস্ত করবেন না তার বার বার্তা বিভিন্ন সময়ে দিয়ে এসেছেন। এমনকী, কিছুদিন আগে নেতাজি ইন্ডোরে দলের বৈঠকে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে কড়া সতর্কবার্তা দিয়েছেন। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ ও সতর্কতাকেও ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে কসুর করছে না শিক্ষায় দুর্নীতি ও অনিয়মের কারবারিরা। এই দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে কীভাবে একশ্রেণীর শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা দফতরের এক শ্রেণীর কর্মী জড়িয়ে গিয়েছে তার কদর্য ছবিটাও বারবার সামনে বেরিয়ে আসছে।
বরাহনগর শরৎচন্দ্র ধর প্রাথমিক বিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ-এর গত কয়েক বছর ধরে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দফতরে একাধিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এমনকী বরাহনগর থানাতেও মণীশ-সহ কয়েক শিক্ষকের বিরুদ্ধে স্কুলে ঢুকে ধমকানো এবং চমকানো, হুজ্জতি, মারপিট-এর মতোও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এমন গুরুতর অভিযোগ-এর তদন্ত করা দূরে থাক উল্টে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দফতর মণীশকুমার নেজ-দের মতো দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারবারীদের হাত মজবুত করার কাজই করে গিয়েছে বলে অভিযোগ। যারা মণীশকুমার নেজদের মতো দুর্নীতি ও অনিয়ম-এর দোষে দুষ্ট শিক্ষকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তাদের হয় সাসপেনশন-এর হুমকি অথবা পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় বদলির অর্ডার ধরানো হয়েছে বলে অভিযোগ।
মণীশকুমার নেজ-এর মতো শিক্ষকদের নৈতিকতার অধঃপতন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মণীশের বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতির তদন্তে বরাহনগর সার্কেলের স্কুল পরিদর্শক সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়কে এনকোয়ারি অফিসার করার কথা নিশ্চিত করেছিলেন ডিআই সঞ্জয়কুমার চট্টোপাধ্যায়। ১০ অক্টোবর সেই শুনানির ২ মাসের মধ্যে মণীশ নেজ-এর বিরুদ্ধে চার্জশিটও জমা দেওয়ার কথা ছিল সুস্মিতার। কিন্তু, মণীশকুমার নেজ-কে অনৈতিকভাবে রেজলিউশন পাস করিয়ে বরাহনগর সার্কেল স্পোর্টস-এর মাথায় বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সুস্মিতার বিরুদ্ধে। ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলিতে সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দিন কয়েক পরেই আর একটি বৈঠক ডেকে সার্কেল স্পোর্টস কমিটির মাথা থেকে মণীশকুমার নেজ-এর বদলে তণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সদস্য স্নিগ্ধা সাহাকে বসিয়ে দেন। এমনকী, সেই বৈঠকে রেজলিউশন পাস করাতে নতুন খাতা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্কুল পরিদর্শক সুস্মিতা। এই নিয়ে বাকি শিক্ষকরা আপত্তি জানালে সুস্মিতার যুক্তি ছিল আগের খাতা হারিয়ে গিয়েছে। সুতরাং ওই রেজলিউশন মানা হবে না। অভিযোগ স্কুল পরিদর্শক সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তুমুল হইহট্টগোল ও সভায় মারপিট-এর উপক্রম হয়েছিল।
অভিযোগ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি-কে সঙ্গে নিয়ে প্রায় একক জেদে স্কুল পরিদর্শক সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়-কে সার্কেল স্পোর্টস কমিটির মাথায় বসিয়ে দেন। এমনকী স্নিগ্ধা সাহা-র নামে সার্কেল স্পোর্টস-এর আমন্ত্রণপত্রও ছাপানো হয়ে যায়। কিন্তু, স্কুল পরিদর্শক সুস্মিতা মুখোপাধ্যায় ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলির খবরের চাপে মণীশকুমার নেজকে কমিটির মাথা থেকে সরিয়ে দিলেও আসলে তাঁকেই স্পোর্টস পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ৩০ নভেম্বর মাঠে দেখাও যায় স্কুল পরিদর্শকের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন মণীশ নেজ এবং তাঁর নেতত্বেই পুরো স্পোর্টস পরিচালনা করা হয়।
স্বাভাবিকভাবেই সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের এহেন আচরণে দ্বিচারিতা-ই দেখছেন বরাহনগর সার্কেলের অধিকাংশ শিক্ষক। এমনকী সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের এমন আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন সব সংগঠনেরই সদস্য শিক্ষকরা। একজন প্রধানশিক্ষক যিনি ছাত্র পেটানো থেকে শুরু করে স্কুল-উন্নয়নের অর্থ নয়ছয়, স্কুলের মধ্যে বাইরের প্রকাশনা সংস্থার বই বিক্রি করা, ডোনেশন নিয়ে ছাত্র ভর্তি এবং মিড-ডে মিল-এর হিসাবে গরমিল-এর মতো অভিযোগে অভিযুক্ত, তাঁকে নিয়ে স্কুল পরিদর্শক সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের অবস্থান নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। বরাহনগর সার্কেল-এ দলমত নির্বিশেষে অধিকাংশ শিক্ষকই স্কুল পরিদর্শকের এই অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করছেন। মণীশ নেজ-এর ছাত্র পেটানো থেকে অর্থ নিয়ে ছাত্র ভর্তি, বাইরের প্রকাশনা সংস্থার বই বিক্রি-র ভিডিও সর্বসমক্ষে আসার পর বহু শিক্ষকই প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু, স্কুল শিক্ষা দফতর যেভাবে হালকা চালে গোটা মণীশ নেজের দুর্নীতি-তে জড়ানোর তদন্ত করছে তাতে ক্রমশই ক্ষোভ বাড়ছে।
বহুদিন থেকেই বরাহনগর সার্কেলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে বহু অনিয়ম এবং দুর্নীতি হচ্ছে। আদি তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি করা বহু শিক্ষকেরই অভিযোগ, সিপিএম আমলে সেই সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা সরব হয়েছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁরা সরব হয়েছিলেন তাঁরাই এখন নাম লিখিয়েছেন তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিতে। ফলে, আখেরে লাভ কিছুই হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষা থেকে যে দুর্নীতিকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন তা সফল হয়নি। এর জন্য তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির এইসব আদি সদস্যদের অভিযোগ, সিপিএম যে দলতন্ত্রকে কায়েম করে শিক্ষায় দুর্নীতি করেছিল, সেই একই ধারা এখনও অব্য়াহত। মণীশ নেজ এবং প্রাথমিক স্কুল শিক্ষা পর্ষদের একশ্রেণীর আধিকারিকের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন এঁরা। মণীশ নেজও একটা সময় সিপিএম-এর শিক্ষক সংগঠন-এর সদস্য ছিলেন। মণীশ নেজ এবং তাঁর বেশকিছু সঙ্গী পরে রঙ বদলে তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিতে নাম লিখিয়েছেন। আর এঁরাই এখন বরাহনগর সার্কেলে প্রাথমিক শিক্ষকদের উপরে দাদাগিরি চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ। তাহলে আজ বরাহনগর সার্কেলে প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে যে হইচই চলছে তার পিছনে কি রঙ বদলের রাজনীতি-ই দায়ী? আর সেই কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষার ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়েছে? প্রশ্ন কিন্তু ক্রমশই উঠছে।