‘চোখের জলে মা তোর বিদায়বেলা’- বিষাদ মুছে মন তবু মেতে ওঠে বিজয়ার আনন্দে
‘মায়ের প্রতিমা গলে যায় জলে বিজয়ায় ভেসে যায়।’ সত্যিই তাই- মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন পর্বের সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্তে বিষাদ মিলিয়ে গিয়ে বিজয়ার আনন্দ আর মিষ্টিমুখে পরিবেশ হয়ে ওঠে মিলন মধুর।
'চোখের জলে আজ মা তোর বিদায় বেলা'- বিজয়া দশমীর পুজোর সমাপ্তীতে মায়ের সপরিবারে ঘরে ফেরার পালা। সিঁদুর খেলা সাঙ্গ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় প্রতিমা নিরঞ্জনের। মায়ের প্রতিমা গঙ্গায় জলে পড়লেই বিষাদের সুর বদলে যায় বিজয়ার শুভেচ্ছায়। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভ শক্তির জয়ের বার্তা দিয়ে যান মা। মা দুর্গার সেই বার্তার রেশ নিয়েই হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মানুষ মেতে ওঠেন শুভেচ্ছা বিনিময়ে।
কবি লিখেছেন, 'মায়ের প্রতিমা গলে যায় জলে বিজয়ায় ভেসে যায়।' সত্যিই তাই- মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন পর্বের সঙ্গে সঙ্গেই মুহূর্তে বিষাদ মিলিয়ে গিয়ে বিজয়ার আনন্দ আর মিষ্টিমুখে পরিবেশ হয়ে ওঠে মিলন মধুর। হিংসা-বিদ্বেষ মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসে বাঙালির বড় উৎসব দুর্গা পুজো।
বিজয়া দশমীর পুণ্যলগ্নে মা যাত্রা করেন কৈলাসে। তাই দুর্গা মাকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দে মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। বাঙালির এই উৎসব সব নিরানন্দ হরণ করে নেয় নিমেষে। সনাতন এই বিশ্বাস চলে আসছে সেই পুরাকাল থেকে। আজও সেই বিশ্বাস অটুট বাঙালি মনে।
পঞ্জিকা মতে, এবার মায়ের আগমন হয়েছিল নৌকায়। সেই অনুযায়ী ফল হল অতি বৃষ্টি ও শস্যবৃদ্ধি। আর মা গমন করছেন ঘোটকে। তার ফল হল রোগের প্রকোপ ও ফসল নষ্ট। তবে মানুষের বিশ্বাস, মঙ্গলময়ী দেবী দুর্গা জগতের কতল্যাণের জন্য মর্ত্যে আবির্ভূতা হন, তিনি সন্তানের মঙ্গলই করবেন।
পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছিল মহালয়ের পুণ্যলগ্নে। মহাষষ্ঠীর তিথিতে দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছিল মর্ত্যে। আর বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে মা অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সপ্তমীর সকালে। বাঙালির বিশ্বাসে মা প্রতি বাড়িতে আসেন ঘরের মেয়ে হয়ে। তারপর চারদিন চলে তাঁর যত্ন-আত্তি। মাকে আরাধনার মধ্য দিয়েই বাঙালি পরিবার এই সুখানুভূতি লাভ করে। আর নবমী নিশি কাটলেই বিষাদের আবহে তার কৈলাস যাত্রায় কেঁদে ওঠে তাঁদের মন।
মা যেমন মহানবমী তিথিতে অসুর নিধন করে শান্তি দান করেছিলেন স্বর্গধামে, অকাল বোধনে মায়ের আশীর্বাদে রামচন্দ্র যেমনভাবে নবমী তিথিতে রাবণ বধ করে অশুভ শক্তি ধ্বংস করেছিলেন, সেইভাবেই জগতের অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতেই প্রতি বছর দেবী দুর্গার আবাহন করা হয়। সেই আঙ্গিকে চারদিনের উৎসবের পর একাধারে বিষাদের পরিবেশ অন্যদিকে বিজয়ার শুভেচ্ছায় মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস।
আচার মেনেই দেবীর কৈলাস যাত্রার পরই বিজয়ার আনন্দে শুরু হয় মিষ্টিমুখ। সনাতন বিশ্বাস, বিশ্ব চরাচর আসুরিক শক্তিমুক্ত হয় এই পূণ্যলগ্নে, তাই শুভ শক্তির জয়ের আনন্দে পরস্পর মেতে ওঠেন কোলাকুলি ও আনন্দ উৎসবে। বাঙালি সমাজে এই বিশেষ দিনে তাই গুরুজনদের প্রণাম ও বাড়ির ছোটদের ভালবাসা জানানোই রীতি।