ফিটন গাড়ি হাঁকিয়ে আন্দুল রাজবাড়ির পুজোয় এসেছিলেন ক্লাইভ, এনেছিলেন ১০৮টি পদ্ম
আন্দুল-রাজ রামলোচন রায় ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার পর রাজবাড়িতে প্রচলন করেন দুর্গাপুজোর। আর তারপরই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বয়ং ক্লাইভ।
যাঁর হাতে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল পলাশির প্রান্তরে, সেই লর্ড ক্লাইভের হাত ধরেই হাওড়ার আন্দুল রাজবাড়িতে দূর্গাপুজোর সূত্রপাত। নিছকই গল্পকথা নয়, ঐতিহাসিক সত্য। আন্দুল-রাজ রামলোচন রায় 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত হওয়ার পর রাজবাড়িতে প্রচলন করেন দুর্গাপুজোর। আর তারপরই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বয়ং ক্লাইভ। এমনকী প্রথম বছরের পুজোয় ফিটন গাড়ি হাঁকিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং ইংরেজ সাহেবও।
১৭৭০ সাল। ক্লাইভের দেওয়ান রামলোচন রায়ের জমিদারি স্থাপিত হয়েছিল আটটি মৌজায়। ক্লাইভের সুপারিশেই শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন 'রাজা' উপাধিও। প্রিয়পাত্রের বাড়িতে এমন আনন্দানুষ্ঠানের স্বাক্ষী থাকবেন না, তা হয় নাকি! তাই তিনি এসেছিলেন। আভিজাত্যের আড়ম্বরে কোথাও কোনও খামতি ছিল না।
সপ্তমীর সকাল। সবে কামানের তুর্যধ্বনিতে শুরু হয়েছে দেবীপূজা। রাজবাড়ির সামনে এসে থামল সারি সারি জুড়িগাড়ি। পিছনে সুসজ্জিত ফিটন। জুড়িগাড়ি থেকে ডালার পর ডালা সন্দেশ নামছে। পিছনের ফিটন থেকে নামলেন এক গোরা সাহেব। হঠাৎ শোরগোল পড়ে গেল। এ যে সেই লর্ড ক্লাইভ সাহেব। পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন যিনি।
আন্দুল রাজবাড়িতে সেই প্রথম দুর্গাপুজো। রাজবাড়ির বৈভবের খামতি নেই। খামতি নেই আড়ম্বরেরও। সেই জৌলুসের পারদ আরও চড়ে গেল ক্লাইভের পদার্পণে। তিনি আবার সঙ্গে এনেছিলেন দশ হাজার টাকার সন্দেশ, দেবীর পাদপদ্মে নিবেদনের জন্য ১০৮টি পদ্ম। আর এক হাজার টাকা প্রণামীও দিয়েছিলেন ওই ইংরেজ সাহেব।
রাজবাড়ির ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল নতুন এক ঐতিহ্যের। সে ঐতিহ্য আড়ম্বর-আভিজাত্যের। কামান গর্জন, তূর্যধ্বনি, আলোর রোশনাই, কাঙালি ভোজন, নাচমহলের বেলোয়ারি ঝাড়ের টুংটাং শব্দের সঙ্গে বাইজিদের মুজরো- সেই আভিজাত্যেরই স্মারক ছিল। বিষাণ বাজিয়ে মহাসমারোহের রাজবাড়ির শারদ-বন্দনায় একটি মহিষ, ১২টি ছাগ উৎসর্গ করা হয়েছিল সেবার।
এখন হারিয়ে গিয়েছে সেই জৌলুস। তবে ঐতিহ্য রক্ষায় খামতি নেই কোথাও। রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য অরুণাভ মিত্র বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞায় কামান গর্জন ও বলি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু পুজোর বাকি সমস্ত রীতিই রয়েছে আগের মতো। এখনও কৃষ্ণা-নবমী তিথিতে কল্পারম্ভ হয়। অন্যান্য পুজো শুরুর আগেই ধূমধাম করে শুরু হয়ে যায় আন্দুল রাজবাড়ির পুজো।
রাজবাড়ির মাঠে মেলা বসে। তবে বাইজিদের সেই মুজরোর আসর আর বসে না। সেই জায়গায় নতুন একটি অনুষ্ঠান যুক্ত হয়েছে এখন। রাজবাড়ির সদস্যরা একত্রিত হয়ে ধুনুচি নাচে অংশ নেন। অষ্টমীর দিন রাতে এই ধুনুচি নাচে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি হয় পুজোর রাজবাড়িতে।
মন্দিরের আদলে এসেছে আধুনিকতার স্পর্শ। আগের সেই বেলোয়ারি ঝাড় নেই। তার জায়গায় স্থান পেয়েছে আধুনিকমানের ঝাড়বাতি। এখনও রীতি মেনেই আটমণ মাটি দিয়ে তৈরি হয় একচালা প্রতিমা। তবে এই দুর্গা প্রতিমার বিশেষত্ব হল- এখানে মায়ের বাহন সিংহের মুখ ও গ্রীবাদেশ ঘোড়ার মতো। প্রতিমায় কোনওরূপ পরিবর্তন করা হয়নি। প্রথম থেকেই একই ধাঁচের প্রতিমার রেওয়াজই চলে আসছে।