আঁচলা ভরা শিউলি ফুল নিয়ে ছুটছে অপু-দুর্গা, চারিদিকে বেজে উঠেছে মহাঅষ্টমীর দুন্দুভি
মাঠ পেরিয়ে সেই যে বিশাল ঝিলটা রয়েছে, তার পাশ দিয়ে উচু-উচু ঘাসের জঙ্গল, তারমধ্যে দিয়ে রয়েছে একটা পা-এ চলার পথ। সেই বরাবর একটু এগিয়ে গেলে মেলে রেল লাইনে। আর সেই রেল লাইনের এপারে রয়েছে কাশফুলের বনটা।
মাঠ পেরিয়ে সেই যে বিশাল ঝিলটা রয়েছে, তার পাশ দিয়ে উচু-উচু ঘাসের জঙ্গল, তারমধ্যে দিয়ে রয়েছে একটা পা-এ চলার পথ। সেই বরাবর একটু এগিয়ে গেলে মেলে রেল লাইনে। আর সেই রেল লাইনের এপারে রয়েছে কাশফুলের বনটা। আশ্বিন মাসের এই সময়ে সেই বনে যে ঝাঁকেঝাঁকে ফুল আসে। রেল লাইনের ঠিক ওপারে রয়েছে শিউলি ফুলের গাছটা।
জমির আল ধরে ছুটছে অপু-দুর্গা।দু'জনের মধ্য়ে প্রতিযোগিতা কে আগে পৌঁছতে পারে। ভোরের আকাশে লালচে ভাব। সূর্যটা উঠবে উঠবে করছে। নিশ্চিন্দিপুর থেকে রেল লাইনের দূরত্ব কয়েক ক্রোশ। অবশ্য এখন আর ক্রোশের হিসাবটা ক'জন রাখে। ব্রিটিশরা যতদিন না পর্যন্ত মাইলের হিসাব রাখছিল ততদিন গ্রাম-বাংলায় ক্রোশ শব্দটা ছিল। এই একুশ শতকে এখন মাইলেরই চল। তাই কয়েক ক্রোশ মানে অনেকটাই পথ।
কিছুটা দৌড়নোর পর অপু পা চুলকোতে-চুলকোতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাই-এর কীর্তি দেখে কিছুটা বিরক্ত দুর্গা। আরে বাবা ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে মণ্ডপে যে পৌঁছতে হবে। অপুর পা-চুলকোতে চুলকোতে আলের উপর বসে পড়েছে। ভোরের আলোয় দুর্গা দেখল অপুর পা-এ চাকা-চাকা হয়ে ফুলে রয়েছে। অপু কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল বন-বিছুটি। দুর্গা সঙ্গে সঙ্গে অপুর বাঁহাতের মুঠোটা আলগা করল। বেরিয়ে এল কয়েকটা নাটা ফল। অপুর ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। নাটা ফলের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও গাছের তলায় একটা দু'টো-একটা ফল পড়ে থাকে। অপুর নাটা ফলের নেশা যে তাকে ভোরবেলায় বন-বিছুটির জঙ্গল ভেদ করে গাছতলায় নিয়ে গিয়েছে বুঝতে পারে দুর্গা। আলের পাশে কিছুটা গোবর পড়েছিল দুর্গা তড়িঘড়ি নিয়ে এসে অপুর পা-এ লাগিয়ে দিল। ফের ছুট লাগাল দুই ভাই-বোন।
নিশ্চিন্দিপুরে একটি মাত্র পুজো। তাও আবার সেই জমিদার বাড়িতে। পটলিদের বাগানের ভিতর দিয়ে সপ্তমীর পুজো দেখে ফেরার পথেই অপু-কে পরিকল্পনাটা বলে রেখেছিল দুর্গা। পাশের বাড়ির পিসিমা, যার বয়স নব্বই পেরিয়েছে, তিনি নাকি বলেছিলেন মহাঅষ্টমীর অঞ্জলিতে শিউলি ফুল ও কাশফুল এনে মা-এর পায়ে দিলে পূণ্য়ি হয়। গ্রামে একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে বটে কিন্তু সেটা তো ঘোষালদের বাগানে। সেখানে ঢোকে কার সাধ্যি। আর কাশফুল তো গ্রামে নেই, যেখানে আছে সেটা তো রেললাইনের ধার। নিশ্চিন্দিপুর থেকে কয়েক ক্রোশ। ওখানেই একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে বটে। অবশ্য অপু-দুর্গার কাছে এই কয়েক ক্রোশ পথ কোনও দূর-ই নয়। প্রায়ই দুই ভাই-বোন ছোঁয়াছুয়ি খেলতে খেলতে আধ ঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যায়। এতো আর শহরের রাস্তা নয়। মাঠ ভেদ করে কত শর্টকার্ট রাস্তা রয়েছে।
ভোরের বেলায় চুপি-চুপি বেরিয়ে তাই ফুল সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েছে অপু-দুর্গা। গ্রামের দিকে একটু হালকা হিম পড়ছে। দুর্গা শাড়ির আঁচলটাকে শরীরের সঙ্গে এমনভাবে পেঁচিয়ে নিয়েছে যাতে ঠান্ডা না লাগে। অপুর ধুতির একটা খোটা বের করে তার শরীর ঢেকে দিয়েছে দুর্গা। এরজন্য অন্যদিনের তুলনায় দৌড়ের গতিটা একটু কমে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কুছ পরোয়া নেই দু'জনের।
হরিহর এখন পুজোর কাজে বাইরে। ফিরবেন দ্বাদশীতে। বাড়িতে মা এখন ঘুমে মগ্ন। জমিদার বাড়িতে অষ্টমীর অঞ্জলি শুরু হওয়ার অনেক আগেই ফিরে আসতে পারবে তারা- পুরোটা ভালো করে ভেবে দেখে নিয়েছে দুর্গা। আর তাই ভোরবেলাতেই ভাই-কে ঘুম থেকে তুলে ছুট লাগিয়েছে রেললাইনের ধার লক্ষ করে।
ছুটতে ছুটতেই দুর্গা-অপু দেখল ঝিলের মধ্যে ফুঁটে রয়েছে অসংখ্য পদ্ম। কিন্তু এখন পদ্ম তোলার আর সময় নেই। তারমধ্যে এই ভোরে পদ্ম তোলাটাও বিপজ্জনক। কোথায় সাপ পেঁচিয়ে আছে কে-জানে! কাশফুল, শিউলি ফুল-টা নিয়ে ফের আসতে পারলেই ঢের! মনে মনে জপে নেয় দুর্গা।
উঁচু ঘাসের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পা-য়ে চলার রাস্তাটা ধরে এগোতে এগোতে কাশফুলের বনের সামনে হাজির হয়ে যায় ভাই-বোন। অপু চখচখটা জ্বল-জ্বল করছে। উপরের ভোরের নীলাকাশের দিকে মাথাগুলো তুলে দিয়ে কাশফুলগুলো তখন দোলা খাচ্ছে। ভোরের হালকা আলোয় দুধ-সাদা কাশফুলে যেন এক মায়াবী প্রলেপ। দুর্গা আর দেরি না করে মাটিতে পড়ে থাকা কয়েকটা কাশফুল তুলে নেয়। গাছ থেকে ফুল তুলবে না দুর্গা। কারণ এখন সে জানে গাছেরও প্রাণ আছে। দিদি কাশফুল তুলে নিয়েছে দেখতে পেয়েই রেল লাইনের কাছে ছুট লাগিয়েছে অপু। রেল লাইনের ওপারেই রয়েছে শিউলি ফুলের গাছটা। ওদিক থেকে দুর্গা সমানে অপুকে ডেকে যাচ্ছে। তার চিন্তা রেল লাইনটা যেন দেখে পার হয় ভাই। রেল লাইনের ধারে পৌঁছতেই বিষয়টি নজরে এল দুর্গা-অপুর। কাশফুলের বন ভেদ করে এগিয়ে আসছে মা-দুর্গার একটা মুখ। বিশালরকমের মুখ সেটি। খানিকটা ভয়-ভয়ও করছে। আর ঠিক এই মা-দুর্গার মুখের পিছনে কারা যেন ঢাক আর সাঁনাই বাঁজাতে বাঁজাতে আসছে। কাশফুলের বন-এ এমনভাবে মা-দুর্গার মুখে শরীরটাকে ঢেকে আছে যে বাকি অংশ দেখা যাচ্ছে না। মা-দুর্গার মুখটা একটু এগিয়ে আসতেই দুর্গা-অপু দেখল পিছনে আরও সব ঠাকুর। কে নেই সে দলে গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতি, সিংহ, অসুর, শিব, ময়ূর। আর এদের পিছনে একটা দল ঢাক, সাঁনাই, কাসর বাঁজাতে বাঁজাতে চলেছে।
দুর্গা-অপু এদেরকে চেনে। এরা প্রায়ই বিভিন্ন দেবতার রূপ ধরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেবতাদের কথা শোনায়। এখন দুর্গাপুজো তাই এমনভাবে সেজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দলটি কাশফুলের বন দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে পূব-আকাশে সূর্যটাও লালচে-গোল ভাব কাটিয়ে কিরণ দিতে শুরু করেছে। শিউলি ফুলের গাছের তলায় পড়ে রয়েছে গাদা-গাদা ফুল। শাড়ির আঁচল ভরে শিউলি ফুল তুলে নেয় দুর্গা। কিছুটা ফুল আবার অপুর ধুতির খোটাতেও বেঁধে দেয়। এমন-ই সময় রেল লাইন ধরে বিশাল হর্নটা বাজাতে বাজাতে রেল গাড়ির ইঞ্জিনটা দূরে কোথায় মিলিয়ে গেল। রেল গাড়ির ইঞ্জিনের চালক দুর্গা-অপু-কে দেখে হাতও নাড়ল। অপু আবার হাত নাড়তে নাড়তে রেল লাইন ধরে ছুটতে শুরু করেছিল। দিদি-র হালকা ধমক খেয়ে সে দৌড় থামিয়ে ফিরে এল।
শিউলি ফুলের গাছের পিছনেই রয়েছে অনেকটা চাষের জমি। আর চাষের জমি পরেই রয়েছে একটা গ্রাম। সেখান থেকে খুব ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। মানে মহাঅষ্টমীর পুজো শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। অপুর হাত ধরে রেল লাইনে টপকে ফের বাড়ির দিকে ছুট লাগাল দুর্গা। কাশফুলের বনটাকে একপাশে রেখে ছুটে চলেছে ভাই-বোন। আনন্দে আত্মহারা অপু দুহাতে শিউলি ফুলে বাঁধা ধুতির খোটাকে ধরে চিৎকার করে চলেছে। চিৎকার করে বলছে 'বলো দুর্গা মাইকি', ওপাশ থেকে দুর্গা বলে উঠছে 'জয়'। দুর্গা, শিবের মুখোশ পরে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলা দলটাকে সামনে দেখতে পাচ্ছে অপু-দুর্গা। ওই দলের বাজানো ঢাকের আওয়াজ, সাঁনাই-এর শব্দের মাত্রাটা ক্রমশই বেশি করে শুনতে পাচ্ছে তারা। আর ততই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাই-বোন বলে চলেছে 'বলো দুর্গা...'।