পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কি বর্ণবাদী ছিলেন
চীনাদের তিনি বলেছেন 'নোংরা এবং স্থূলবুদ্ধির' লোক। মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের তার মনে হয়েছে 'যেন নরক থেকে উগড়ে দেয়া'। শ্রীলংকার মানুষ সম্পর্কেও তাঁর ডায়েরিতে রয়েছে বাজে মন্তব্য।
আইনস্টাইনের নতুন প্রকাশিত ভ্রমণ ডায়েরিতে দেখা যাচ্ছে তিনি বর্ণবাদী এবং বিদেশি-বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন।
আইনস্টাইন এই ভ্রমণ ডায়েরি লিখেছিলেন ১৯২২ সালের অক্টোবর হতে ১৯২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত যখন তিনি এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে সফরে গিয়েছিলেন।
এই ডায়েরিতে তিনি বিদেশিদের ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক এবং নির্বিচার মন্তব্য করেছেন। যেমন চীনাদের তিনি বলেছেন, 'পরিশ্রমী কিন্তু নোংরা এবং স্থূলবুদ্ধির লোক।'
আইনস্টাইন অবশ্য পরবর্তী জীবনে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করেন। তখন তিনি বর্ণবাদকে 'শ্বেতাঙ্গ মানুষের ব্যাধি' বলে বর্ণনা করেন।
আইনস্টাইনের এই ডায়েরি এই প্রথম ইংরেজি ভাষায় আলাদা বই হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত বইটির নাম, "দ্য ট্রাভেল ডায়েরিজ অব আলবার্ট আইনস্টাইন: দ্য ফার ইস্ট, প্যালেস্টাইন এন্ড স্পেন, ১৯২২-১৯২৩।"
বইটি সম্পাদনা করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আইনস্টাইন পেপার্স প্রজেক্টের সহকারী পরিচালক জিভ রোজেনক্রানয।
আইনস্টাইন স্পেন থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে শ্রীলংকা এবং সেখান থেকে চীন এবং জাপান সফরে গিয়েছিলেন।
মিশরের পোর্ট সাইদে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন, "এখানে চারিদিকে নানা রঙের লেভেনটাইনস, এদেরকে যেন নরক থেকে উগড়ে দেয়া হয়েছে।" (লেভান্ট বলতে বোঝায় একটি বিরাট অঞ্চল যার মধ্যে সাইপ্রাস, মিশর, ইরাক, ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া এবং তুরস্ক পর্যন্ত দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়)। পোর্ট সাইদে বিদেশি জাহাজে পণ্য বিক্রি করতে উঠতো তারা।
শ্রীলংকার কলম্বোর অভিজ্ঞতা বর্ণন করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, "এরা মাটির ওপর মারাত্মক নোংরা পরিবেশে এবং কটু গন্ধের মধ্যে থাকে। এরা কাজ-কর্ম করে সামান্যই, আর এদের চাহিদাও সামান্য।"
তবে নামকরা এই পদার্থবিজ্ঞানী তার সবচেয়ে বাজে মন্তব্য করেছেন চীনাদের সম্পর্কে। তিনি চীনা ছেলে-মেয়েদের 'উদ্যমহীন এবং ভোঁতাবুদ্ধির' বলে বর্ণনা করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'এরা যদি আর সব জাতিকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলে কী হবে।'
আলবার্ট আইনস্টাইন সারা বিশ্বে একজন মানবতাবাদী বিজ্ঞানী হিসেবেই পরিচিত। ইউরোপে হিটলারের উত্থানের পর ১৯৩৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
১৯৪৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটিতে দেয়া একটি বক্তৃতায় বর্ণবাদকে 'শ্বেতাঙ্গ মানুষদের ব্যাধি' বলে বর্ণনা করেছিলেন।
ওয়াশিংটন থেকে বিবিসির ক্রিস বাকলার লিখেছেন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব মহাকাশ এবং সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা আমূল পাল্টে দিয়েছিল। কিন্তু এই ডায়েরি পড়ে বোঝা যায় বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষ সম্পর্কে আইনস্টাইনের নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছিল।
অন্যান্য খবর: বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা উন্মাদনা কবে থেকে?
ঈদে মেহেদী দেয়ার প্রচলন কিভাবে এসেছে ?
সাতটি চার্টে জেনে নিন বিশ্বকাপের সব তথ্য
এই ডায়েরি যদিও ব্যক্তিগত ভাবনা হিসেবে লেখা হয়েছে, এটি প্রকাশিত হওয়ায় এখন তা যুক্তরাষ্ট্রে অনেককে আহত করতে পারে। সেখানে অনেকেই আইনস্টাইনকে বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের একজন আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখেন।
১৯৩৩ সালে যখন আইনস্টাইন অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, সেখানে স্কুলে, সিনেমায় শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের একেবারে বিচ্ছিন্ন এবং আলাদা জীবন তাকে অবাক করেছিল। তিনি যোগ দিয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সংগঠন, 'ন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অব কালার্ড পিপলে।"
জার্মানিতে যেভাবে ইহুদীদের চরম অত্যাচার-নির্যাতন এবং বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছিল, তার সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।
লিংকন ইউনিভার্সিটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার খুব বিখ্যাত একটি বক্তৃতার জন্য তাই আইনস্টাইন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিয়েছিলেন।
আইনস্টাইনের এই নতুন প্রকাশিত ডায়েরি পড়ে অনেকে হয়তো বলতে পারেন, তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই হয়তো এই ডায়েরিতে লিখেছেন।
একবিংশ শতাব্দীতে আজকের পটভূমিতে তা আইনস্টাইনের মর্যাদা এবং খ্যাতিকে ক্ষুন্ন করতে পারে। কারণ তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে যেমন, তেমনি একজন মানবতাবাদী হিসেবেও সারা বিশ্বে সমাদৃত।
বিবিসির ক্রিস বাকলার বলছেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে আইনস্টাইন এই ডায়েরি লিখেছিলেন জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের ভয়ংকর চেহারা দেখার আগে। জার্মানিতে এই বর্ণবাদ থেকে বাঁচতে তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।