ছাত্রনেতা থেকে পতিদার আন্দোলন, একনজরে দেখুন হার্দিক প্যাটেলের রাজনৈতিক জীবন
গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের আগেই পাল্টি খেলেন পতিদার নেতা হার্দিক প্যাটেল। কিছুদিন আগেই তিনি কংগ্রেস দল ছেড়েছিলেন এবং তখন থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে তিনি হয়ত গেরুয়া শিবিরে যোগ দেবেন। সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে হার্দিক বৃহস্পতিবারই যোগ দিলেন বিজেপিতে। প্রসঙ্গত, ২৮ বছরের প্রাক্তন এই কংগ্রেস নেতা, রাজ্যে পতিদার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন।
বক্তা হিসাবে দারুণ হার্দিক প্যাটেল
গুজরাতের বিরামগামের পতিদার-অধ্যুষিত ছোট গ্রাম চন্দন নগরির বাসিন্দা হার্দিক প্যাটেল। হার্দিক তাঁর জোরালো বক্তব্যের জন্য সর্বদাই পরিচিত ছিলেন। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানিয়েছেন যে হার্দিক তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করার পর থেকেই তিনি তাঁর জোরদার বক্তব্যের মাধ্যমে জনসাধারণকে আকর্ষণ করতেন। ২০১০ সালে হার্দিক আহমেদাবাদের সহজানন্দ কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন এবং তাঁর স্নাতকের পড়া সম্পূর্ণ করেন। কলেজে পড়াশোনা করার সময় হার্দিক সাধারণ সম্পাদকের জন্য ভোটে দাঁড়ান এবং বিজয়ী হন।
পূর্ণ রাজনীতিতে যোগ
২০১২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে হার্দিক প্যাটেল যোগ দেন ললিল প্যাটেলের নেতৃত্বাধান দল সর্দার প্যাটেল গ্রুপে (এসপিজি)। হার্দিকের রাজনৈতিক গুরু হিসাবেও পরিচিত ললিত প্যাটেল, যিনি হার্দিককে হাতে ধরে রাজনীতি করা শিখিয়েছেন। তাঁর শক্তিশালী বক্তৃতার কারণে, হার্দিককে ভিরামগাম তালুকের প্রধান করা হয়েছিল।
পতিদার আন্দোলনের প্রধান মুখ হন হার্দিক
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সুরাতে প্যাটেল সম্প্রদায়ের আলোচনায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন হার্দিক প্যাটেল সহ তৎকালীন পতিদার অনামত আন্দোলন সমিতির আহ্বায়ক নিখিল সাভানি, আল্পেশ কাঠিরিয়া, সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পতিদার সংরক্ষণকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এই দলটি কলেক্টর দপ্তরে যায় এবং পতিদার সংরক্ষণের দাবি নিয়ে চিঠি জমা দেয়। এরপর এই দলটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেতে শুরু করেন এবং যখনই দলটি কালেক্টরের অফিসে যেতেন তখন প্রচুর মানুষের জমায়েত হত। প্রথমদিকে এই আন্দোলনের প্রধান মুখ ছিলেন নিখিল সাভানি, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়ার ফলে লালজি প্যাটেল এই আন্দোলনের প্রধান মুখ হিসাবে হার্দিক প্যাটেলকে করার সিদ্ধান্ত নেন।
হার্দিকের পতিদার আন্দোলন
২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে একটা বৈঠকে হার্দিকের বিরুদ্ধে তহবিলের অর্থ অপচয় করার অভিযোগ ওঠে। সেই সময় ললিত প্যাটেল হার্দিককে এসপিজি থেকে সরিয়ে দেন। এরপর হার্দিক নিজে পাস বলে একটি দল গঠন করেন এবং পতিদার আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যান। এই দলের প্রধান মুখ হার্দিক হওয়ায় ব্যাপক সমর্থন মেলে সাধারণের জন্য এবং তিনি আন্দোলনের প্রধান হয়ে ওঠেন। ওই বছরের অগাস্টেই সুরাতে ২০০ জনের ছোট দলের একত্রিত হওয়ার কথা থাকলেও দেখা যায় লক্ষাধিক মানুষ সেখানে জমায়েত হয়েছেন। ওই বছরের ২৫ অগাস্ট পাসের ডাকা বিপুল জমায়েত ডাকা হয় আহমেদাবাদের জিএমডিসি মাঠে এবং তিনমাস আগেই এই ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও ২৪ অগাস্টই লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয়ে যান। পুলিশ কমিশনার ও আহমেদাবাদের কালেক্টর ২৪ অগাস্ট হার্দিকের সঙ্গে দেখা করেন এবং পতিদার সংরক্ষণের দাবি করা চিঠি গ্রহণ করেন। তবে তার পরের দিনই জনসভা হয় এবং এখানে হার্দিক অনশনে বসেন। ওইদিন সন্ধ্যায় পুলিশ মাঠে এসে লাঠিচার্জের মাধ্যে জমায়েত ছত্রভঙ্গ করেন এবং হার্দিক প্যাটেল সহ একাধিক পতিদার নেতাকে তুলে নিয়ে যায়।
গুজরাতে আগুন জ্বলতে থাকে
লাঠিচার্জ ও পুলিশ হার্দিক প্যাটেলকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং পুরো গুজরাতের প্যাটেল সম্প্রদায় হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। আপক হিংসার ঘটনা ঘটে গুজরাত জুড়ে। এই ঘটনা থামাতে সেনাকে ডাকা হয়, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কার্ফু জারি করা হয়। ওই বছরের ২৬ অগাস্ট হার্দিক প্যাটেল সহ সমস্ত পতিদার নেতাদের ভিডিও তৈরি করতে এবং সহিংসতা বন্ধ করার জন্য লোকদের কাছে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। এই ঘটনায় একাধিক পুলিশ আহত হন এবং ১৪ পতিদার সম্প্রদায়ের মানুষ মারা যান একাধিক গুলি চালানোর ঘটনায়। এই ঘটনার তিনমাস পর অক্টোবরে হার্দিক প্যাটেল এক বিবৃতিতে বলেন যে তাঁর দল আত্মহত্যা করবে না, কিন্তু পুলিশকে হত্যা করবে। যার জেরে হার্দিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের হয় এবং তিনি গ্রেফতার হন।
জামিন পেয়ে থাকতে হয় গুজরাতের বাইরে
৯ মাস জেলে থাকার পর ২০১৬ সালের জুলাই মাসে হার্দিক প্যাটেলকে জামিনে ছাড়া হলেও তাঁকে ৬ মাসের জন্য গুজরাতের বাইরে থাকার শর্ত দেয় আদালত। জেল থেকে বেরোনোর পর তাঁকে গুজরাত ছাড়ার জন্য ২ দিন অর্থাৎ ৪৮ ঘণ্টার সময় দেওয়া হয়। তাঁকে স্বাগত জানাতে জেলের বাইরে হাজির ছিল বিপুল মানুষ। এরপর হার্দিক রাজস্থানের উদয়পুরে চলে যান।
বিজেপির বিরোধিয়ায় পতিদার
২০১৭ সালে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে পতিদার বিজেপির বিরোধিতা করেছিল। বিজেপি অনেক জায়গায় আসন হারায়, কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে সামান্য আসন নিয়ে জিততে পেরেছিল গেরুয়া শিবির। হার্দিক প্যাটেলের একাধিক ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাঁর সঙ্গ ছেড়ে দেন। কেউ কেউ বিজেপিতে যোগ দেন আর বাকিরা পতিদার আন্দোলনকারী হিসাবে রয়ে যান। ২০১৭ সালের অগাস্টে, আনন্দীবেন প্যাটেল গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালে, হার্দিক প্যাটেল পতিদার সংরক্ষণের জন্য ১৯ দিনের জন্য অনশন করেছিলেন।
কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে সফর
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধী, সাংসদ রাহুর গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর উপস্থিতিতে হার্দিক প্যাটেল কংগ্রেসে যোগ দেন। ২০২০ সালের জুলাইতে গুজরাত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং সভাপতি পদে নিয়ুক্ত হন। তিনি ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ নেতা যিনি এ ধরনের পদ অর্জন করেন। তবে একাধিক অভিযোগ নিয়ে ২০২২ সালের ১৮ মে হার্দিক প্যাটেল কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে হার্দিক প্যাটেল টুইটারে লেখেন, 'জাতীয় স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে, জনস্বার্থে এবং সামাজিক স্বার্থের অনুভূতি নিয়ে আজ থেকে আমি একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি। ভারতের সফল প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র ভাই মোদীর নেতৃত্বে জাতির সেবার মহৎ কাজে আমি একজন ক্ষুদ্র সৈনিক হিসেবে কাজ করব।'
হাত ছাড়লেন হার্দিক , সহস্তে তুলে নিলেন পদ্মের পতাকা