মোদীর ভারতের গঙ্গাপ্পা, চাষি থেকে বনেছিলেন 'মহাত্মা', ঘটে গেল মর্মান্তিক পরিণতি
বেঙ্গালুর-হায়দরাবাদ রোডের উপরে তাঁর দেখা মিলত। অন্ধপ্রদেশের অনন্তপুর শহরের লাগোয়া হাইওয়ের উপরে ছিল বছর তিরাশির গঙ্গাপ্পার বাস।
বেঙ্গালুর-হায়দরাবাদ রোডের উপরে তাঁর দেখা মিলত। অন্ধপ্রদেশের অনন্তপুর শহরের লাগোয়া হাইওয়ের উপরে ছিল বছর তিরাশির গঙ্গাপ্পার বাস। হাইওয়ের উপর দিয়ে যাওয়া বহু মানুষের চোখ পড়ত গঙ্গাপ্পার উপরে। যেন বর্তমানের 'মহাত্মা গান্ধী'। মাথা থেকে শরীর পুরোটাই সাদা পাউডারে রাঙানো। চোখে মহাত্মার চশমা। কিন্তু, যে হাইওয়ে ছিল অশীতিপর গঙ্গাপ্পা-র রোজগারের ঠিকানা, সেই হাইওয়েতে গাড়ি-র ধাক্কা কেড়ে নিল তাঁর জীবন।
গঙ্গাপ্পার কাহিনি সারা দেশের মানুষ প্রথম জেনেছিল 'পারি' নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে। যারা গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবন-যাত্রা নিয়ে সংবাদ পরিবেশনার কাজ করে। এমনকী, গঙ্গাপ্পার মর্মান্তিক এই পরণতির খবরও সকলকে জানিয়েছেন 'পারি'-র সঙ্গে যুক্ত ইনডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট রাহুল.এম। রাহুল-এর কলমেই প্রথম জানা গিয়েছিলেন গঙ্গাপ্পা-র কথা।
রাহুল জানিয়েছেন, বি কৃষ্ণনাইয়া নামে এক রেশ ডিলার কাম রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টের কাছ থেকে একটি ফোন পান তিনি। কৃষ্ণনাইয়া নাকি তাঁকে জানান যে গান্ধী-র ডায়েরি থেকেই রাহুলের নম্বর তিনি পেয়েছেন। কৃষ্ণনাইয়ার কাছেই রাহুল জানতে পারেন দিন কয়েক আগে হাইওয়ের উপরে একটি গাড়ি গঙ্গাপ্পা-কে ধাক্কা মারে। রাস্তার উপরে অনেকক্ষণ পড়েছিল মহাত্মা গান্ধী সাজে সজ্জিত গঙ্গাপ্পার দেহ।
হাইওয়ের পাশেই এক চা-এর দোকানে গঙ্গাপ্পার সঙ্গে পরিচয় স্থানীয় বাসিন্দা এই কৃষ্ণনাইয়ার। সেখানেই বহুক্ষণ ধরে গঙ্গাপ্পার সঙ্গে আড্ডাও মারতেন তিনি। কিন্তু, কৃষ্ণনাইয়া কোনওদিনই জেনে উঠতে পারেননি গঙ্গাপ্পার আসল ঠিকানা বা তাঁর গ্রামের কথা। কৃষ্ণনাইয়ার মতো আরও অনেকের কাছে গঙ্গাপ্পার পরিচয় ছিল গান্ধী।
রাস্তার ধারে একটি খাবারের দোকানে তলায় রাতের বেলা আশ্রয়। সকাল হলেই ফের গান্ধী সেজে হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে পড়তেন গঙ্গাপ্পা। মাঝে মাঝে চলে যেতেন অনন্তপুর শহরের ভিতরে। পারি-র সঙ্গে যুক্ত ইনডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট রাহুল জানিয়েছেন, গঙ্গাপ্পার কথা তিনি প্রথম জানতে পেরেছিলেন ২০১৭ সালের মে মাসে। বেরিয়ে পড়েছিলেন এক ৮৩ বছরের বৃদ্ধ-র রোজ গান্ধী সেজে হাইওয়ে-তে দাঁড়ানোর কাহিনি সংগ্রহে।
রাহুল জানিয়েছেন, ৭০ বছর ধরে জমিতে চাষের কাজে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছিলেন গঙ্গাপ্পা। কিন্তু, একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে জমির মধ্যেই জ্ঞান হারান। এরপর আর সেই কাজ করতে পারতেন না। কিন্তু, অভাবের সংসারে কীভাবে অন্ন সংস্থান হবে? এই ভেবে দড়ি বোনার কাজ শুরু করেন। এতে বাধ সাধল বয়স। বয়স জনিত কারণে ছানি পরা চোখে দড়িও ঠিক করে বুনতে পারতেন না। শেষমেশ একদিন নেমে পড়লেন মহাত্মার সাজে ,হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্থ রোজগারের আশায়।
আয় মন্দ হত না। দিনে অন্তত ১৫০ টাকা আয় বাধা ছিল। কোনও কোনও দিন তার থেকেও বেশি আয় হত। একবার একটি মেলায় গান্ধী সেজে কয়েক ঘণ্টায় এক হাজার টাকার উপরেও আয় করেছিলেন ৮৩ বছরের গঙ্গাপ্পা।
রোজ সকালে ১০ টাকার পন্ডস পাউডারের প্যাকেট থেকে সাদা পাউডার নিয়ে মুখ ও শরীরে তা মেখে নিতেন। স্থানীয় এক দোকান থেকে ১০ টাকা কিনেছিলেন গান্ধী চশমা। ১০টাকা দিয়ে একটা লাঠিও কিনেছিলেন গঙ্গাপ্পা। আর সাজ ঠিক হল কি না তা দেখার জন্য তাঁর কাছে ছিল মোটরবাইকে ভাঙা আয়না। এই আয়না কোথাও থেকে সংগ্রহ করেছিলেন গঙ্গাপ্পা। ৮০ পার হওয়া এক মানুষের এমন জীবন সংগ্রাম স্বাভাবিকভাবেই চোখে জল এনে দিয়েছিল রাহুলের।
কৃষ্ণনাইয়া যিনি রাহুলকে গঙ্গাপ্পার মর্মান্তিক পরিণতির সংবাদ দিয়েছিলেন তিনি জানতে চেয়েছিলেন গঙ্গাপ্পার বাড়ি ঠিকানা। রাহুলের কাছেও গঙ্গাপ্পার বাড়ির ঠিকানা ঠিকমতো ছিল না। গঙ্গাপ্পার পরিবারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল বটে কিন্তু, বাড়ির ঠিকানাটা ঠিক করে জানা হয়নি। রাহুল শুধু জানতেন গঙ্গাপ্পার বাড়ি হাইওয়ে থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও একটা গ্রামে।
রাহুল অবশ্য একটা সূত্র দেন কৃষ্ণনাইয়া-কে। গঙ্গাপ্পা দলিত ছিলেন বলে জানান রাহুল। গঙ্গাপ্পা যে এই দলিত পরিচয় নিয়ে শঙ্কায় তাও জানান রাহুল। কারণ, গঙ্গাপ্পা মাঝে মধ্যে রাতে একটি মন্দিরে শুতে যেতেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল তাঁর দলিত পরিচয় জানলে হয়তে সেখানে ঘাড় ধাক্কা জুটবে। রাহুলের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে অবশেষে গঙ্গাপ্পার পরিবারকে খুঁজে বের করেন কৃষ্ণনাইয়া। ১০ ডিসেম্বর পরিবারের হাতে গঙ্গাপ্পার দেহ তুলে দেওয়া হয়েছে। শেষকৃত্য সম্মন্ন হয়েছে গঙ্গাপ্পার। আর সেই সঙ্গে যবনিকা পড়েছে এক ৮৩ বছরের বৃদ্ধের গান্ধী সাজার কাহিনি-র।