দেশের ক্রীড়া-নীতির পরিবর্তন আনাই সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্ন
তাঁর বাঁ পায়ের জাদু আজও কলকাতা ময়দানকে মোহিত করে রেখেছে। সেই সুবাস তিনি ছড়াতে চেয়েছেন রাজনীতির ময়দানেও। মমতার কৃপাদৃষ্টি লাভ করে এ দেশের গোটা ফুটবল-সমাজের প্রতিভূ হয়ে তিনি সংসদে পা রেখেছেন।
তাঁর বাঁ পায়ের জাদু আজও কলকাতা ময়দানকে মোহিত করে রেখেছে। সেই সুবাস তিনি ছড়াতে চেয়েছেন রাজনীতির ময়দানেও। মমতার কৃপাদৃষ্টি লাভ করে এ দেশের গোটা ফুটবল-সমাজের প্রতিভূ হয়ে তিনি সংসদে পা রেখেছেন। এতদিন কোনও ফুটবলার-সাংসদকে পায়নি ভারতীয় সংসদ। বাংলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ফাঁকটুকু ভরাট করেছেন। এবার তাঁর স্বপ্ন সত্যি করার পালা। বাংলার ক্রীড়াসমাজকে সাজিয়ে তোলার একরাশ স্বপ্ন যে তাঁর বুকে।
না, শুধু ক্রীড়াসমাজকে নিজের স্বপ্ন দিয়ে সাজানোই তাঁর লক্ষ্য নয়, সবুজ-মেরুনের 'ঘরের ছেলে' সাংসদ প্রসূন তাঁর নির্বাচনী-ক্ষেত্র মোহনবাগানের শক্ত ঘাঁটি হাওড়াকেও তাঁর স্বপ্ন দিয়ে তৈরি করতে চান। তিনি ভেবেছেন এলাকার মানুষের উন্নয়ন করতে। চেষ্টাও করেছেন যথাসাধ্য। অনেক করেছেন। আবার অনেক কিছু করতে পারেননি। করার ইচ্ছা আছে, তাগিদ আছে। তবু পিছুটানও আছে। আছে বিরোধীদের অপ্রাপ্তীর গঞ্জনা। রাজনীতির মাঠে গোল করা যে একেবারে অন্য ব্যাপার সেটা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছেন তিনি।
সাংসদ হওয়ার পর কী কী কাজ করেছেন?
- হাওড়ার পাশ দিয়ে প্রসারিত হয়েছে তিন-তিনটি হাইওয়ে। তাই দুর্ঘটনার ঝক্কি অনেকটাই বেশি এই জেলাতে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষের সার্থে সাংসদ হয়েই প্রসূনবাবু ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুলেন্স চালু করেন। এই অ্যাম্বুলেন্সে এমনই প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে, যাতে চড়লেই 'গ্রিন করিডর' পরিষেবা মিলবে। অর্থাৎ অ্যাম্বুলেন্স যে রাস্তা দিয়ে ছুটবে সেই রাস্তা সিগন্যাল সবুজ হয়ে যাবে। এই প্রকল্পে সাংসদ ব্যায় করেছেন ১ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা।হাওড়া সদর হাসপাতালে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যায়ে সিআরএএম মেশিন দিয়েছেন সাংসদ।
- অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই মেশিন বোন অপারেশনে ব্যবহৃত হয়। ২৭ লক্ষ টাকা ব্যায়ে হাওড়া হাসপাতালের আইটিইউ-তে তিনটি বেড চালু হয়েছে তাঁর সাংসদ কোটায়। উত্তর হাওড়ার টিএল জয়সওয়াল হাসপাতালে রোগীর আত্মীয় স্বজনের বসার জন্য কোন প্রতীক্ষালয় বা বিশ্রামাগার ছিল না। ছিল না কোন ক্যান্টিন।
- প্রসূনবাবু তাঁর এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে এই হাসপাতালে একটি ব্লক তৈরি করেছেন। এই ব্লকের মধ্যেই রয়েছে প্রতীক্ষালয়, ক্যান্টিনও। হাওড়ায় হাই মাস্ট লাইটের পরিষেবা প্রথম আসে তাঁর হাত ধরেই। শুধু শহরই নয় সাংসদের ভাবনায় অগ্রাধিকার পায় গ্রামও। হাওড়া সংসদ ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত গ্রাম্য এলাকা পাঁচলা ও সাঁকরাইলের রাস্তাও আলোকিতকরণে এই বিশেষ আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পাঁচলার ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও সাঁকরাইলের ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতে এই পরিষেবা চালু আছে।
- এছাড়া রাস্তা ও পানীয় জল পরিষেবায় সাংসদের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গঙ্গা থেকে জল তুলে পরিস্রুত করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নয়া পরিকল্পনাও রয়েছে সাংসদের। ইতিমধ্যেই সাঁকরাইলে জল প্রকল্পের জন্য জমিও চিহ্নিত করা হয়েছে।হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের ৭০টি ক্লাবে প্রসূনবাবুর সাংসদ তহবিল থেকে জিম পরিষেবা চালু হয়েছে। হাওড়ার অধিকাংশ ক্লাবেরই নিজস্ব কোনও খেলার মাঠ নেই।
- যে সমস্ত ক্লাবের নিজস্ব খেলার মাঠ রয়েছে সেই সমস্ত ক্লাবে ফ্লাড লাইট দেওয়া হয়েছে। হাওড়ায় সে অর্থে স্টেডিয়াম অপ্রতুল। সেই কারণে শিবপুর পুলিশ লাইনের মাঠে স্টেডিয়াম গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। ইতিমধ্যেই ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ক্লাব হাউস, ড্রেসিংরুম, গ্যালারি স্থাপনের জন্য। এই কাজ সম্পূর্ণ হলে ৩০ লক্ষ টাকা ব্যায়ে ফ্লাড লাইট দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সাংসদের।
- হাওড়ার বাসস্ট্যান্ডগুলি স্মরণীয়-বরণীয় মানুষের ছবি ও বাণীতে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে সাংসদের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে। বেলুড়মঠ বাসস্ট্যান্ডকে যেমন বেলুড়মঠের আদলে সাজানো হয়েছে, তেমনই গুরুদ্বার বা খাজাবাবার পীঠের আদলে সাজিয়ে তোলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বাসস্ট্যান্ডগুলিকে। হাওড়ার গুণীজন-তুলসী চক্রবর্তী, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার, শঙ্করীপ্রসাদ বসু-দের মতো অনেকেরই জীবনী, বাণী ও ছবিতে সাজিয়ে তোলা হয়েছে বাসস্ট্যান্ড।
- হাওড়ার সংস্কৃতি সচেতন মানুষ এখনও লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়েন। সেই কারণে লাইব্রেরি উন্নয়নের পরিকল্পনাও রয়েছে হাওড়ার সাংসদের। লাইব্রেরিতে বই থেকে শুরু করে কম্পিউটার দিয়েছেন। স্কুলের উন্নয়নের কম্পিউটার দিয়েছেন। হাওড়ার সাহিত্য সংসদের হাতে বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি রয়েছে। দাবি মেনে সেগুলি আর্কাইভের ভাবনাও রয়েছে প্রসূনবাবুর।
- সাংসদ কোটার বাইরেও কাজে অগ্রণী প্রসূনবাবু। বেলুড় মঠ থেকে জয়রামবাটি, কামারপুকুর পর্যন্ত বাস পরিষেবা চালু করার পিছনেও রয়েছে তাঁর উদ্যোগ। তিনিই পরিবহণমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রকল্পের উদ্বোধন ২৫ নভেম্বর। দেশের ফুটবলের উন্নতির লক্ষ্যেও তিনি সরব হয়েছেন সংসদে।
- জিরো আওয়ারে তিনি ভারত সরকারের স্পোর্টস-পলিসি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, অন্যান্য স্পোর্টস নিয়েও তিনি ভাবছেন। হাওড়ায় একটি স্পোর্টস এরিনা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। সেখানে দু'টি পার্ট অবশ্যই থাকবে। একটি শ্যুটিং, অন্যটি তিরন্দাজি। প্রথমটি সামলাবেন জয়দাপ কর্মকার, দ্বিতীয়টি দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে জায়গা চিহ্নিতকরণও হয়ে গিয়েছে।
কোন দিকে খামতি?
- সাংসদ কী কাজ করছেন, কী কাজ করার চেষ্টা করছেন। তা জানেন না সাধারণ মানুষ। তাঁরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। সাংসদ সাধারণ মানুষের কাছের লোক হয়ে উঠতে পারেননি। সাংসদ-বিধায়ক-জন প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার নির্দেশ দিলেও, তারকা তকমা ঘোচাতে ব্যর্থ প্রসূনবাবু।
-
বিরোধীরা
বলছেন
একজন
ক্রীড়াবিদ
হিসেবে
তাঁর
সুনাম
আছে,
কিন্তু
সাংসদ
হিসেবে
ব্যর্থ।
সংসদে
হাওড়ার
মানুষের
জন্য
গলা
ফাটাননি
তিনি।
মানুষের
সমস্যার
কথা
তুলে
ধরেননি।
নিজে একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ, হাওড়ার খেলাধূলা নিয়ে তাঁর চিন্তার কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখেননি বাংলা তথা হাওড়ার মানুষ। ডুমুরজলা স্পোর্টস কমপ্লেক্স নিয়ে তাঁর কোনও বিশেষ ভাবনা রয়েছে কি না, জানেন না কেউ। এলাকার মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন, অন্তত জেলার খেলাধূলার মানোন্নয়নে কিছু করুন প্রসূনবাবু।
হাওড়ায় পর্বতারোহনে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। রয়েছে অনেক অভিযাত্রী সংগঠন। সাঁতার নিয়েও উৎসাহ কম নেই জেলায়। -
এই
সব
খেলার
প্রতিযোগীদের
আরও
উৎসাহিত
করতে,
তাঁদের
বিশেষ
সুবিধা
প্রদানে
ক্রীড়াবিদ-সাংসদের
কী
ভূমিকা,
প্রশ্ন
তুলছেন
বিরোধীরা।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার প্রশ্ন তুলেছেন, সালকিয়ায় প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি ভবন নির্মাণ হয়েছিল। সেটি এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কোনওরকম দেখভাল করা হয়নি তার। সাংসদ কোটার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে, অথচ বস্তি উন্নয়ন, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। - এলাকায় সে অর্থে কোনও কমিউনিটি হল বা পাবলিক হল নেই শরৎ সদন ছাড়া। তা নির্মাণের কোনও উদ্যোগ নেই। সেই বাম আমলে শরৎ সদন হয়েছিল, তারপর আর পরিকল্পনা কোথায়? সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে একটি লোকসভা কেন্দ্র। সাতটি না হোক দু'-একটি কমিউনিটি হলের পরিকল্পনা তো এই আড়াই বছরে করা যেত।
কী বলছেন বিরোধীরা?
হাওড়ার তারকা সাংসদকে ঘিরে হাওড়ার মানুষের চাহিদাও আকাশ ছোঁয়া। যেমন তারকা প্রার্থী, তেমন তাঁর কাছ থেকে পাওয়ার আশা তৈরি হয়েছে আকাশচুম্বী। কিন্তু এই আড়াই-তিন বছরে তার কিয়দংশও পূরণ করতে পারেননি সাংসদ। মানুষের কোনও প্রার্থনাই তিনি কর্ণগোচর করেননি। হাওড়ার মানুষের কথা চিন্তা করেননি তারকা প্রার্থী। ভোটের আগে মানুষের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
মানুষের জন্য কাজ করার বার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদ। মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটাই তৈরি হয়নি। ক্রমশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে সাংসদের। সোজা কথায় বিরাট বড় ব্যক্তিত্ব হলেও, মানুষের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে ব্যর্থ তিনি। সেটাই তাঁর কাছে অন্তরায় হয়ে যাচ্ছে রাজনীতির ময়দানে। ফলে গোলের কাছে পৌঁছে গোল দেওয়া হচ্ছে না তাঁর।
সাংসদ কী বলছেন?
একজন ক্রীড়ার জগতের মানুষ যখন সাংসদ বা বিধায়ক হয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সবসময়ই খেলাধুলোর উন্নতির জন্য একটা বাড়তি তাগিদ থাকে। সেই তাগিদই তাঁকে অনেক কিছু করার উৎসাহ জোগায়। ফুটবলের 'অর্জুন' প্রসূনও তাই সংসদে গিয়ে দেশকে খেলাধূলার জগতে উচ্চাসনে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। লড়াই চালাতে চান ক্রীড়া উন্নয়নে। তিনি বলেন, 'ভাবতে পারেন, আমাদের কোনও স্পোর্টস বাজেট নেই। অটলবিহারী বাজপেয়ী একবার চেষ্টা করেছিলেন।
তার আগে '৯২ সাল নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাহায্য পাননি। আমিও তা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে চাই। শেষদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। প্রসূনবাবুর কথায়, 'আমার একটা বড় সুবিধা সর্বকালের সেরা 'ক্যাপ্টেন' মমতাকে পেয়েছি। তাঁর টিমে লড়াই চালানোর মতো স্পিরিট রয়েছে। সেই স্পিরিটই আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।'