নোট বাতিল নিয়ে মনমোহনের বার্তা আসলে ইতিহাসের প্রতিশোধ
একসময় তাঁকে 'মৌনী মনমোহন' বলে কটাক্ষ করা হত কিনতু রাজ্যসভায় ডিমনেটাইজেশন-এর জোরালো সমালোচনা করে তিনি বোঝালেন যে তিনি ফেলনা নন।
ভারতের উদার অর্থনীতির রূপকার তাঁকেই বলা হয়। আর সেই অর্থনীতিবিদ-রাজনীতিবিদ মনমোহন সিংহ যখন দেশের অর্থনীতির সম্বন্ধে মুখ খোলেন, তখন ৫৬-ইঞ্চি ছাতির দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রীকেও শুনতে হয় তাঁর কথা।
আর ঠিক সেটাই দেখা গেল সম্প্রতি যখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্যসভায় বর্তমান সরকারের নোট বাতিলের পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেন -- রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, এখন অর্থনীতির পণ্ডিত হিসেবে।
মনমোহন যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (২০০৪-১৪) তখন তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে তাঁকে কম টিপ্পনি কাটেনি তৎকালীন বিরোধী দল বিজেপি। "মৌন মনমোহন" বলে তাঁকে প্রায়ই কটাক্ষ করা হত। আর আজ যখন সেই মনমোহন তাঁর প্রিয় বিষয় অর্থনীতি নিয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করলেন, তখন কিনতু বিশেষ 'প্রত্যাঘাত' দেখা গেল না বিজেপির পক্ষ থেকে।
ঘোর গণতন্ত্রের এই বাতাবরণে সবাই যখন সব কিছু জানার দাবি করে থাকেন, তখন মনমোহন সিংহের মতো পণ্ডিত মানুষরাই পার্থক্য গড়ে দেন। মোদী সরকারের এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে "পাহাড়প্রমাণ অপদার্থতা" বলেই মনমোহন ক্ষান্ত হননি, গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়েও দিয়েছেন কেন তা তিনি বলেছেন। আর আজকালকার এঁড়ে তক্কো করা পোস্ট-ট্রুথ যুগের রাজনীতিকরা যেখানে মানুষের পক্ষে লড়াই করার ভান করে আদতে তাঁদেরকে আরও বিভ্রান্ত করেন, সেখানে একজন প্রকৃত জ্ঞানী হিসেবে মনমোহনের এই বিরোধিতা সত্যিই বিরল।
সংসদে পেশ করা মনমোহনের সংক্ষিপ্ত কিনতু জোরালো বক্তব্য যেন তাঁর হয়ে ইতিহাসের প্রতিশোধ নেওয়া। ইউপিএ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে গিয়ে মনমোহন চূড়ান্ত নাজেহাল হয়েছিলেন। বলা হয়েছিল তিনি কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর হাতের পুতুল, নিজের সরকারের উপরেই তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, এমনকী কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীও একবার জনসমক্ষে মনমোহন সরকারের একটি প্রস্তাবিত খসড়াকে "ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত" বলেও তাঁকে যথেষ্ট লজ্জিত করেছিলেন। সেসবের প্রতিশোধ যেন মনমোহন সিংহ নিলেন এক মুহূর্তে, তাঁর প্রাজ্ঞ দেখিয়ে।
মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, রাহুল গান্ধী সহ অনেক নেতাই পথে নেমেছেন। কিনতু তাঁদের বিরোধিতা প্রধানত রাজনৈতিক। মোদী যুগে ক্রমাগত কোনঠাসা হয়ে পড়া বিরোধীদের চাঙ্গা করতে এর চেয়ে বড় উপলক্ষ্য আর হতে পারতো না, কিনতু মনমোহনের বিরোধিতা সম্পূর্ণই অর্থনৈতিক। তাঁর "এর ফলে জাতীয় বৃদ্ধি কমে যাবে" বা "সাধারণ মানুষ নিজের পয়সারই নাগাল পাচ্ছে না" জাতীয় মন্তব্য বুঝিয়ে দেয় অবস্থা কতটা গুরুতর।
এনডিএ-তে বিজেপির বিক্ষুব্ধ মিত্র শিবসেনা নিমেষে মনমোহনের বক্তব্যকে হাতিয়ার করে মোদী সরকারকে বিদ্ধ করে। দলনেতা উদ্ধভ ঠাকরে সরকারকে পরামর্শ দেন মনমোহনের কথাগুলি শুনতে। মনমোহন সিংহ আজও দেশের মধ্যে অন্যতম বড় অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ। তাঁর কথার দাম যে ফেলনা নয়, অন্তত অর্থিনীতির বিষয়ে, তা বুঝতে শিবসেনার বিশেষ সময় লাগেনি। কিনতু বর্তমান সরকার কি তা গ্রহণ করবে?
সংকীর্ণ রাজনীতির উপরে কি আমরা উঠতে পারব?