মরিয়া মমতা এবারে মুর্শিদাবাদ জিততে রাজনৈতিক কৌশল বদলেছেন; কিন্তু ওষুধে কাজ হবে কি?
পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস চলতি লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিয়াল্লিশটার মধ্যে বিয়াল্লিশটা আসনই জিততে মরিয়া।
পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস চলতি লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিয়াল্লিশটার মধ্যে বিয়াল্লিশটা আসনই জিততে মরিয়া। কারণটা সুস্পষ্ট: নিজের উঠোনে যতটা পারা যায় শক্তি বাড়িয়ে নিয়ে জাতীয় স্তরে সরকার গড়ার লক্ষ্যে ঝাঁপানো। কিন্তু তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় কাঁটা মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলা। এই দু'টি জেলায় অতীতের বড় শক্তি কংগ্রেস এখনও শক্তপোক্ত এবং ১৯৯৮ সালে দলগঠনের পরে বাকি রাজ্য জয় করলেও এই দুই জেলাতেই শাসকদল এখনও নিজেদের বিজয়ধ্বজা তুলতে পারেনি। মালদাতে এবারে তবু আশা রয়েছে তৃণমূলের জেতার কারণ কংগ্রেসের বিদায়ী সাংসদ মৌসম বেনজির নূর সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদ এখনও শক্ত গাঁট আর তার সবচেয়ে বড় কারণ অধীররঞ্জন চৌধুরী।
মুর্শিদাবাদে লোকসভা আসন তিনটি: তৃণমূল একটিতেই প্রথম নয়
মুর্শিদাবাদ জেলার লোকসভা আসন মোট তিনটি -- জঙ্গিপুর, মুর্শিদাবাদ এবং বহরমপুর। এদের মধ্যে জঙ্গিপুর এবং বহরমপুরে কংগ্রেসের সাংসদ আর মুর্শিদাবাদে রয়েছেন সিপিএম-এর বদরুদোজা খান। তৃণমূল ২০১৪-র নির্বাচনে জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদে তৃতীয় স্থানে শেষ করে আর বহরমপুরে দ্বিতীয় হলেও প্রথম স্থানাধিকারী অধীররঞ্জনের কাছে শাসক দলের গায়ক-প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেন হারেন সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি ভোটে। অতএব, ৪২-এ ৪২ করতে হলে তৃণমূলকে এখনও যে বহু পথ পেরোতে হবে, সে কথা তাদের অতিবড় সমর্থকও অস্বীকার করবে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ংও সে কথা জানেন আর জানেন বলেই ঘনঘন মুর্শিদাবাদের মাটিতে প্রচার চালাচ্ছেন। আক্রমণ করছেন অধীরকে, চাঁছাছোলা ভাষায়।
বাকি রাজ্যে অন্য হলেও মমতা মুর্শিদাবাদে সুর চড়াচ্ছেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে
বাকি পশ্চিমবঙ্গে এবারের লড়াই প্রধানত তৃণমূল বনাম বিজেপি হলেও মুর্শিদাবাদের সমীকরণ ভিন্ন। এখানে তৃণমূল এক নম্বর দল নয় এবং বিজেপিরও এখানে বিশেষ অস্তিত্ব নেই। বিজেপির এই জেলাতে বিশেষ সম্ভাবনাও নেই কারণ মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। আর তাই আর বাকি পাঁচটা কেন্দ্রের মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করে মুর্শিদাবাদে কাজ হাসিল করা সম্ভব নয় মমতার পক্ষে।
আর তাই তিনি আক্রমণ করেছেন কংগ্রেসকে, বিজেপির পাশাপাশি। এমনকী, আরএসএস-এর কাছে কংগ্রেস সাহায্য পাচ্ছে এমন অভিযোগও তুলছেন। বিজেপি, কংগ্রেস এবং বামকে এক করে দিচ্ছেন এবং বলছেন একমাত্র ভবিষ্যৎ তাঁর দল তৃণমূলই।
কিন্তু মমতা নিজেই বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করেছেন অতীতে, গুজরাত দাঙ্গার পরেও
এই কৌশলটি সুচিন্তিত। কংগ্রেসকে তাদের অন্যতম শেষ গড়ে হারাতে হলে এবারের লোকসভা নির্বাচনের মোদী বনাম রাহুল গান্ধীর প্রচলিত ন্যারেটিভটিকে ভাঙতেই হবে তৃণমূলকে, সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করতে হবে তৃণমূল বনাম বাদবাকিদের 'নৈতিক লড়াই'-এর থিওরি কারণ এই জেলায় তৃণমূলকে কংগ্রেসের ভোট কাটতে হবে, যা রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তের ঠিক উল্টো পরিস্থিতি। বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসকে একাসনে বসিয়ে দেখানোটা তাই জরুরি যদিও তাতে ভবি কতটা ভুলবে তা বলা মুশকিল।
কারণ, মমতা যদি একদিকে আরএসএসএর কাছে কংগ্রেসের সমর্থনের অভিযোগ তোলে, কংগ্রেসও পাল্টা বলবে ১৯৯৮, ১৯৯৯ এবং ২০০৪ সালে মমতা নিজেই বিজেপির হাত ধরেছিলেন, ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার পরেও। তাই, পশ্চিমবঙ্গে মমতাই বিজেপিকে এনেছিলেন, এই পাল্টা যুক্তি তুলে কংগ্রেস সংখ্যালঘু-প্রধান মুর্শিদাবাদে মমতাকে হারিয়ে দিতে পারে ফের আরেকবার। এদিকে, বহমরপুরে আরএসপি প্রার্থী দিলেও তাদের বামফ্রন্ট শরিক সিপিএম প্রচার চালাচ্ছে অধীরের হয়ে।
তবে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে যে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেস নিজেদের গড়ে ধাক্কা খাওয়া এবং তাদের অনেক নেতা-কর্তা তৃণমূলে যোগ দেওয়াতে শাসক দলের এই ধারণা প্রকট হয়েছে যে অধীর এখন অনেকটাই দুর্বল। শুভেন্দু অধিকারীকে তৃণমূল মুর্শিদাবাদে অনেকদিন ধরে পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় নামিয়েছে ওই জেলায় দলের শিকড় শক্ত করার জন্যে। তারা ভরসা করছে অপূর্ব সরকার ওরফে ডেভিড, যিনি একসময়ে অধীরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং এবারে তাঁর বিরুদ্ধেই লড়ছেন বহরমপুর থেকে, তাঁর উপর। কিন্তু 'মেশিনারি' তৃণমূলে গেলেও তার সঙ্গে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কও সেখানে আপনা-আপনি চলে যাবে কী না, তা জানা যাবে ২৩ মে।
জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদে নির্বাচন আগামী ২৩ এপ্রিল আর বহরমপুরে ২৯ এপ্রিল।