কিউবাও বদলে গেল, বদলাল না শুধু পশ্চিমবঙ্গের লাল ব্রিগেড
একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে চোখে পড়ল ব্যাপারটা। বামেরা নাকি যখন কোন লাইনে ট্রেন চলবে ঠিক করতে রীতিমতো নাজেহাল, তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নাকি ডুব দিয়েছেন ইতিহাসের মহাসাগরে। ছয় দশক আগে ফিরে গিয়ে ফিদেল কাস্ত্রো-চে গেভারার নেতৃত্বাধীনে কিউবার সেই বিখ্যাত বিপ্লবের কথা আবার স্মরণ করেছেন তাঁর পুজোর লেখায়। বর্তমানের ঘোর বাস্তবের মাটিতে পা না রেখে তিনি অতীতের সেই সমস্ত বিপ্লবগাঁথা নিয়ে রোমান্টিসাইজ করাকেই শ্রেয় মনে করেছেন।
এমনকী, যেই সমঝোতার পক্ষে প্রশ্ন তুলে তিনি কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে এক মঞ্চ ভাগাভাগি করেছিলেন কয়েক মাস আগে, তা মুখ থুবড়ে পড়ার পর তাঁকে আর টুঁ শব্দটি করতে শোনা যায়নি। সাম্প্রতিক প্লেনামে তাঁর রাজ্যের অন্যান্য নেতারা জোট চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে লড়াই করলেও বুদ্ধদেব নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন দলীয় মুখপাত্রের শারদসংখ্যার লেখায় -- "চাহিদার বইটি ছাপা শেষ।" কিউবা নিয়ে রোমান্টিসাইজ সেই প্রসঙ্গেই।
অবাক কাণ্ড বটে। যে কিউবা পর্যন্ত এখন ফিদেল কাস্ত্রোর লিগ্যাসি থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে, হাত বাড়িয়েছে বহুদিনের পুরোনো 'শ্রেণীশত্রু' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে; আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সূচনা করেছে এক নতুন অধ্যায়ের -- তার অতীত নিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েছে কিনা দেশের বামশক্তির অন্যতম প্রধান মুখ (যদিও তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে, তবু এই প্রজন্মের জ্যোতি বসু তো তিনিই)। দলটির রাজনৈতিক বাস্তববাদিতা কোন পর্যায়ের তা নিয়ে রীতিমতো ভ্রান্ত হতে হয়। এই মানসিকতা নিয়ে এনারা লড়বেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে?
আসলে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে সিপিএম তথা বামেরা মোটামুটি আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। আর বাংলার বামেদের এই কোনঠাসা অবস্থার জন্যে শুধু যে মমতা দায়ী, তা নয়। কিউবার প্রসঙ্গই যখন উঠল, তখন এই পরিণতির আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটিও বিশ্লেষণ করা যাক।
বামেরা যখন ক্ষমতায় আসে, তখন পৃথিবীজুড়ে তাঁদের অনেক রোল মডেল
বঙ্গে যখন বামেরা ক্ষমতায় আসে, তখন আন্তর্জাতিক দুনিয়া দুই শিবিরে বিভক্ত। ঘোর ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াই তখন পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে। সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম ইত্যাদি নানা দেশ তখন বঙ্গেশ্বদের রোল মডেল (বাম শিবিরের মধ্যেকার আদর্শগত লড়াই মাথায় রেখেই বলছি)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবল ঘৃণার পাত্র। রোজকার লড়াইয়ের রসদের কোনও খামতি নেই।
এরপর চৌত্রিশ বছর কেটে গেল। দুনিয়াময় বদলের দিন এল। একান্নব্বইতে ধসে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। চীনও খোল ধরে রাখলেও ভিতরের কর্মপদ্ধতি বাজারমুখী হয়ে উঠল। বিভক্ত জার্মানিও এক হয়ে গেল। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনার কোনও প্রভাব বামেদের উপর পড়েনি কারণ বঙ্গে তাঁরা তখন ক্ষমতার মধ্যগগনে। যতই যাই হোক, রাজনীতিতে ক্ষমতাই শেষ কথা। অদূরদৃষ্টি বামেরা তখন ভাবেনইনি যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতো রাজ্য রাজনীতিও বদলে যেতে পারে ভবিষ্যতে, তাই সেই বদল এলে কোথা থেকে বিরোধিতা শক্তি হিসেবে লড়াই করার রসদ পাওয়া যাবে, সেই প্রসঙ্গও আসেনি কারও মাথায়।
কিন্তু যখন ক্ষমতা হারালেন, তখন আর অনুপ্রেরণা নেই কোথাও; বদলে গিয়েছে পৃথিবী
আর শেষমেশ যখন সেই ক্ষমতা হারানোর ক্ষণ এল ২০১১ সালে, তখন আমূল পরিবর্তিত দুনিয়াতে বামেরা প্রায় অনাথ। চোখের সামনে বদলে গেল চীন, ভিয়েতনাম এবং কিউবা। আমেরিকার পেশীশক্তি আগের মতোই রইল। হিলারি ক্লিন্টন স্বয়ং এসে দেখা করলেন শত্রু মমতার সঙ্গে। চৌত্রিশ বছর আগে যে দুনিয়া দেখে বাম নেতারা মহাকরণে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছিলেন, বেরিয়ে এসে দেখলেন সবই পাল্টে গিয়েছে। তাহলে এখন ওনারা যাবেন কোথায়? ওনাদের পছন্দসই জায়গা আর এই দুনিয়াতে আছে বলে মনে হয় না। অতএব স্মৃতিসাগরেই ডুব।
বুদ্ধবাবুও তাই করেছেন। আর তাছাড়া করারই বা কি আছে ওনার? সমঝোতার ফর্মুলা ব্যর্থ হয়েছে, সিঙ্গুর নিয়ে স্বপ্ন পুরোপুরি ধুলিস্মাৎ, দলের মধ্যেই এখন রীতিমতো শোরগোল কোন রাস্তায় এগোনো হবে; সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন রাখার মতো মুখ আর কেউ নেই -- সব মিলিয়ে শেষ অবস্থা যাকে বলে। বৃদ্ধ বুদ্ধদেবের নিজের পক্ষে আর এখন নতুন করে মাঠে নাম সম্ভব নয় যা তিনি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন। অন্ধ কানাগলিতে ঢুকে পিতামহ ভীষ্মের মতো হস্তিনাপুরের কুরুবংশের পতন দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই কার্যত। তাই সাহিত্যই আজ ভরসা কবি সুকান্তর ভাইপোর।