দিঘার সৈকতে ২৯ বছর আগের এক ছবি, যা ফিরিয়ে দিল বন্ধুত্বের এক অসামান্য কাহিনি
বন্ধুত্বের এমন এক কাহিনি যা আপনাকে আবেগপ্রবন করে তুলবে। ফেলে আসা সেই বন্ধু আর বন্ধুত্বের কাহিনি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়। সেই কাহিনি এবার ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার পাতায়।
স্মৃতির
সমুদ্দুর,
শুভঙ্কর
মুখোপাধ্যায়--
(দীঘা,
১৫
ই
আগস্ট
১৯৮৭,
আমরা
তখন
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাংবাদিকতা
বিভাগের
ছাত্র)
তখন
বিকেল।
সাগরের
ঢেউ
ছিটকে
দিচ্ছিল
আমাদের
সেদিন।
তার
পাক্কা
তিন
দশক
বাদে
এখন
টের
পাই,
ঠিক
সমুদ্রের
মতোই
,
সময়ের
স্রোতও
আমাদের
অনেক
দূরে
দূরে
ছিটকে
দিয়েছে।
তবু
,
আমাদের
এত
উথালপাতাল
জীবনেও,
সেদিনের
সেই
সমুদ্রস্নানের
ছবিটা
কিন্তু
থেকে
গিয়েছে।
থেকেছে
বটে,
কিন্তু
এতদিন
যেন
বুকভরা
অভিমানে
মুখ
লুকিয়ে
ছিল
সে,
যেমন
রাতের
সব
তারাই
দিনের
আলোর
গভীরে
লুকিয়ে
থাকে।
তিরিশ
বছরের
পারে
ফিরে
পেলাম
সেই
ছবি,
অমলের
বড়বউদির
কল্যাণে,
শিবানীদি।
এখনো
এমন
কিছু
বাড়ি
আছে,
যেখানে
পুরনো
সেই
একান্নবরতী
পরিবারের
রেশটা
থেকে
গিয়েছে।
সেই
সব
বাড়ির
বড়বউদিদের
অবিকল
মা
মা
লাগে।
শিবানীদিও
তেমনি।
নিজের
একান্ত
অ্যালবাম
থেকে
তিনি
এই
মায়াবী
ছবিটা
আমাদের
ফিরিয়ে
দিলেন,
আর
আমাদের
সামনে
খুলে
দিলেন
স্মৃতির
মধুর
ঝাঁপি।
দীঘার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে ছবিটা তুলেছিল অনিতা। এক সময় সে বাংলার হয়ে ভলিবল খেলত, আর তখন সে-ই আমাদের একমাত্র চাকরি-করা বন্ধু। আমি এই ছবিটার নাম দিয়েছিলাম 'নাট্যকারের সন্ধানে ছ'টি চরিত্র'! আমি, অমল, তাপস, নীহার, শুভাশিস আর সঞ্জয় । সেবার কলকাতা থেকে বাসে করে দীঘা গেলাম আমরা স্রেফ বিনা খরচে । এমনকি যাত্রাপথে চা-বিস্কুট-সিগারেটের খরচও লাগেনি। সব দিয়েছিল অন্য বাসযাত্রীরা, মায় বাসের চালক-কন্ডাক্টরও। আমাদের সতেজ সমবেত গান আর কবিতার বিনিময়ে। দীঘার খাওয়াদাওয়া তো পাইস হোটেলে, আড়াই টাকায় যত খুশি খাও। অমল এমন গোগ্রাসে খেয়েছিল যে, হোটেলের ম্যানেজার এসে আমার হাতে ধরে বলেছিলেন, 'দাদা, আপনার বন্ধুকে ওঠান, নইলে ধনে প্রাণে মরে যাব দাদা'! ওই ভরদুপুরে ভরপেট খাওয়ার পরেই সমুদ্রে নেমে পড়েছিলাম আমরা, আর তখনি ওই ঐতিহাসিক ছবি, তিরিশ বছরেও যা পুরনো হয় না, বরং ঝকঝক করে।
রাতেরবেলা সমুদ্রে ভাটার টান, আর আমাদের মদ-সিগারেটের জোয়ার, লম্বা সেশান। ভোর পর্যন্ত, সব অনিতার খরচে। সে এক মজার মাতলামি। ওই উদ্ভাসিত জোছনার মধ্যেও নীহারের মনে পড়ল, 'অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল'! সে পুবপানে চেয়ে গলা ছেড়ে একটা চটুল বাংলা ছায়াছবির গান গেয়ে উঠল, 'ওঠো ওঠো সুরজাই রে ঝিকিমিকি দিয়া'। আমার হঠাৎ মনে হল, মদ খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ব্যাস, আমি চললুম 'সোনার কেল্লা', বেলাভূমি যেন মরুভূমি। উটসফর শেষে সেই জটায়ুর মতো অবিরাম ব্যায়াম শুরু করে দিলাম আমি বালিয়াড়ি জুড়ে। তাপসের মনে হল, এ সব বুরজোয়া ব্যাপার। সে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে খিস্তি সহকারে তারস্বরে বলে উঠল, 'গুলি করে দেব। সি বিচকে মুক্তাঞ্চল করে ছাড়ব আমি'! এ সব দেখে অমল ভাবল, আমাদের দেশমাতৃকা বিপন্ন। সে বালুর ওপরে গাছের ডাল দিয়ে খড়ির গণ্ডি কেটে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানের সুরে বলে উঠল, 'ভাইসব, এটা কাশ্মীরের এল ও সি (প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা)। পেরতে গেছ কি মরেছ। চারদিকে চোরাবালি পেতে রেখেছি কিন্তু'!
এই সব 'বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ' যখন থিতিয়ে এলো, সাগরপারে তখন 'ক্রমে আলো আসিতেছে'। এমনই অলৌকিক ঊষাকালে অনিতা আমার কাছে এসে বলল, 'জানিস, আমি একজনকে ভালবাসি। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারব না কোনোদিন'! আমি জিগ্যেস করলাম, 'কান্না পায় না তোর'? অনিতা বলল, 'না, আমি তো স্পোরটস্ম্যান, একটা স্পিরিট আছে না'! স্পোরটস্ম্যান স্পিরিট! সত্যি বলেছিলি অনিতা? নাকি নিজের অশ্রু ঢাকার জন্যে ও সব তোর লোক-শোনানো কথা! জানি না। শুধু জানি, অনিতা আর বিয়েই করল না। বিয়ে তো করল না অমলও। কারণ জানতে চাইলেই লাজুক একটা হাসি দেয়। আমি বুঝি, ওই হাসিতে একটা অসম্পূর্ণ ভালবাসার গল্প উঁকি মারে। অমল অবশ্য ঘরে বাইরে ভালবাসা কম পায়নি । কথায় আছে, প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে একজন নারী থাকে। অমলের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না, ওর সব সাফল্যের পিছনে পরিমলদা। অমলের বড়দা, এমন মানুষ রেডিওর 'দিল্লি থেকে প্রচারিত বাংলা সংবাদ'-এর মতোই ক্রমশ মায়াময় অতীত হয়ে যাচ্ছে।
যাকগে সে সব। ছবির জগতে ফিরে আসি। ভাবছি, সময় কি আশ্চর্য রকমের দরদী। সে যখন দেয় , একেবারে উজাড় করে দেয়। আমাদের যেমন দিয়েছে অটুট বন্ধুত্ব। সেজন্যেই, এখনো কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে ফোন করে তাপস আমাকে দিয়ে খবরের কাগজের জন্য বাংলা ফিচার লিখিয়ে নেয়। অমলের সাথে ফোনে বাংলা সংবাদমাধ্যমের হাল নিয়ে আলোচনা হয়। নীহারের সাথে আলোচনা হয় রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত। আবার সময় বড় নিঠুরও বটে। অনিতা, শুভাশিস আর সঞ্জয়ের কী খবর জানি না। সময় মাঝেমধ্যে এমনি করে কেড়ে নেয় অনেক কিছুই। 'এই তো জীবন, কালিদা'! অলৌকিক বটে যে, সময়ের এমনতর খামখেয়ালি দেওয়ানেওয়ার মাঝেও স্মৃতির সমুদ্দুরের ওই ছবিটা হারিয়ে যায়নি। বরং সে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে এমন আরো অনেক ছবির অ্যালবাম।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্তিরিট ক্যামপাসে আমরা ছিলাম তখন 'পঞ্চপাণ্ডব'। আমি, অমল, তাপস, নীহার আর প্রদীপ। ক্লাসের শেষে রাখালদার ক্যান্টিনে ঢুকেই ডানহাতের প্রথম বড় জানালাটার পাশে আমরা কলকাতা দূরদরশনের মতো 'দর্শকের দরবারে' বসাতাম। সব প্রডাকট ছিল আমাদের কাছে, নাচ -নাটক-গান-আবৃততি-লেখালেখি-রাজনীতি-লিটিল ম্যাগাজিন। কাজেই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভার মতো পিলপিল করে লোক জুটত আমাদের ঠেকে। বেশিভাগই মেয়ে, আমি বলতাম, 'পৃথিবীর তিন ভাগ মেয়ে, একভাগ ছেলে'! নিয়মিত হাজিরা দিত স্বাতী, সঙ্ঘমিত্রা আর লিপিকা। ছাত্র ভবনের আধো অন্ধকার বারান্দায় খানিক প্রেম করার পর চলে আসত সমর-সহেলিও। আমি তুরন্ত স্থান বদলে লিপিকা-সহেলির মাঝখানে বসে পড়তাম। ওদের মাঝখানে বসলে আমার কেমন যেন একটা কবি কবি ভাব জাগত, কোথা থেকে যেন কলকল করে যত রাজ্যের কবিতা বেরিয়ে আসত। ওই সব অখাদ্য কবিতার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য লিপিকা মাঝেমধ্যেই পাহাড়ে বেড়াতে চলে যেত।
ওই
একই
কারণে
বেচারা
সমরটাও
সাত
তাড়াতাড়ি
সহেলিকে
বিয়ে
করে
ফেলল।
জীবনে
ওই
প্রথম
'বন্ধুর
বিয়ে
'-এর
জন্য
আমরা
যখন
আনন্দে
বগল
বাজাচ্ছি,
তখন
আমাদের
চমকে
দিয়ে
সমর-সহেলির
বিয়ের
বাসরে
সস্ত্রীক
হাজির
হল
প্রদীপ।
কাউকে
কিচ্ছুটি
না
জানিয়ে
সে
যে
কখন
বিয়ে
করে
ফেলেছে,
আমরা
টেরও
পাইনি।
মধুর
প্রতিশোধ
নিতে
ওই
দু'টো
বিয়েকেই
আমি
এমনভাবে
'বাল্যবিবাহ'
বলে
রটিয়ে
দিয়েছিলাম
যে,
সমর
আর
প্রদীপ
তখন
পকেটে
বার্থ
সারটিফিকেট
নিয়ে
ঘুরত।
এমন
আরো
কত
ছবি,
টিভি
সিরিয়ালের
মতো
অশেষ
অনন্ত
আরো
কত
স্মৃতি!
সব
আমরা
ধরে
রেখেছি।
অথচ
মনে
রাখতে
হবে,
সে
ছিল
১৫
পয়সার
বাদামি
পোস্ট
কার্ড
আর
৩৫
পয়সার
নীল
ইনল্যান্ড
লেটারের
যুগ।
স্মারটফোন
তো
দূরের
কথা,
আমাদের
তখন
সেলফোন
বা
ল্যান্ডফোনই
ছিল
না।
কম্পিউটার
তো
ছিলই
না
,
কাজেই
ইমেলও
ছিল
না।
তথাকথিত
সোশ্যাল
মিডিয়ার
পলকা
মোহজালটাও
ছিল
না
তখন।
ছিল
শুধু
বন্ধুত্বের
মায়াবী
টান।
সেই
টানেই
তো
আমাদের
ওই
স্মৃতির
সমুদ্দুরের
ছবি।
আমি
বলি
কি,
ওই
স্মৃতিটাই
হল
আমাদের
যাবতীয়
সম্পর্কের
আসল
কারিগর।
স্মৃতিকে
তাই
আমি
ডিফাইন
করি
মাস
কমিউনিকশনের
ম্যাজিক
মডেল
হিসেবে।
অমলের সাংবাদিক সুলভ একটা আজব কৌতূহল থেকে এই ডাউন মেমরি লেনের জার্নিটা শুরু করেছিলাম, 'এখনের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও কি এভাবে বেড়াতে যায়, নাকি জীবনের বিভিন্ন সম্পর্কের মতোই সব সফরগুলোও এখন ভারচুয়াল হয়ে গেছে'? ঠিক যেমন চিঠির বদলে এসেছে মেসেজ, আড্ডার পরিবর্তে এসেছে চ্যাট! সেই সূত্রেই এসেছিল 'ডাকছে আমায় দীঘাসুন্দরী'-এর প্রসঙ্গটা। আর অমনি বন্ধুর চিঠির মতো প্রিয় ওই ছবিটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন শিবানীদি। কী নাম দেব ওনার, সময়ের ডাকপিওন, নাকি স্মৃতির ডাকহরকরা! জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি যে, ওটা নিছকই একটা ছবি নয়, ওটা আসলে একটা অসামান্য গানের পঙতি , 'পুরনো সেই দিনের কথা'!
শিবানীদি, আমি ফেসবুকে লেখালেখি একদম পছন্দ করি না। তবু এই লেখাটা লিখলাম শুধু আপনার জন্যে। আপনি আমাদের ছবির দেশের সেই স্মৃতির বাড়ির ঠিকানা খুঁজে দিয়েছেন। আমার এই লেখাটা তাই আপনাকে আমার পুষ্পাঞ্জলি। গ্রহণ করুন।
https://www.facebook.com/subhankar.mukhopadhyay.96/posts/328803194254040