স্যান্ডউইচ বিক্রেতা থেকে বলিউড ‘ট্র্যাজেডি কিং’, একনজরে দিলীপ কুমারের রঙীন জীবন
বলিউডের 'ট্র্যাজেডি কিং’ বলা হত তাঁকে। হতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী কিন্তু ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন হিন্দি ইন্ডাস্ট্রির নায়ক। সুদূর পেশোয়ার থেকে বলিউডের সফর মোটেও সহজ ছিল না মহম্মদ ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমারের। বলিউড দাপিয়েছেন ৬ দশক ধরে। সায়রা বানুর সঙ্গে বিয়ের আগে একাধিক নায়িকাদের প্রেমে পড়েছিলেন। বুধবার তাঁর মৃত্যুতে এক যুগের অবসান ঘটল। বলিউড হারালো দিলীপ কুমারকে।
প্রথম জীবন
দিলীপ কুমার পাকিস্তানের পেশোয়ারের কিস্সা খাওয়ানি বাজার এলাকায় মহম্মদ ইউসুফ খান নাম নিয়ে ১১ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে একটি মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দিলীপ কুমারের বাবা ছিলেন ফলের ব্যবসায়ী, তাঁর ফলের বাগানও ছিল। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে, ১২ সদস্যের পরিবার নিয়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান দিলীপ কুমারের বাবা। দিলীপ কুমার নাসিকের কাছাকাছি দেওলিয়ার বার্নস স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তবে প্রথম থেকেই তাঁর বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার দরুণ এক দিন বাড়ি ছেড়েই বেরিয়ে পড়লেন কিশোর ইউসুফ। তাঁর ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন রাজ কাপুর, যিনি পরবর্তীকালে হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিতেও তাঁর সহ-অভিনেতা হন। বাড়ি ছাড়ার পর ইউসুফ ওরফে দিলীপের পুনের কথা মনে পড়ল। সেখানে পৌঁছে আলাপ হল এক ক্যাফে মালিকের সঙ্গে। পাশে পেলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতিকে। তাঁদের সহায়তাতেই দিলীপ কুমার সেনাবাহিনী ক্লাবের কাছে স্যান্ডউইচের দোকান খুলে ফেলেন। তাঁর ব্যবসাও রমরমিয়ে চলতে শুরু করে দেয়।
ফিল্ম ইন্জাস্ট্রিতে প্রবেশ
দিলীপ কুমার বাড়ি ফিরলেন বেশ কয়েক হাজার টাকা জমিয়ে। তখনও পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্যবসায়ী হওয়ার। এরপর তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মাসানি নামের এক ব্যক্তির। তিনি ইউসুফকে দেখেই বুঝতে পারেন যে তিনি ব্যবসার জন্য তৈরি হননি বরং তাঁর স্থান গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিতে। মাসানির হাত ধরেই বম্বে টকিজে প্রবেশ দিলীপ কুমারের। এরপর অভিনেত্রী দেবিকা রানী তাঁকে প্রথম অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পায় মহম্মদ ইউসুফ খানের প্রথম ছবি 'জোয়ার ভাঁটা'। তার প্রকৃত নাম মহম্মদ ইউসুফ খান হলেও হিন্দি লেখক ভগবতি চরণ বর্মা তাকে বড় পর্দায় নাম দেন দিলীপ কুমার। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দিলীপ কুমারকে।
কর্মজীবন
বক্স অফিসে 'জোয়ার ভাটা' সেভাবে সফলতা না পেলেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। তবে আরও বেশ কয়েকটি অসফল সিনেমার পর নুর জাহানের বিপরীতে ১৯৪৭ সালে মুক্তি পাওয়া 'জুগনু' দারুণ হিট হয়। এরপর দিলীপ কুমার ১৯৪৮ সালে পরপর শহিদ ও মেলা দুটি হিট ছবি উপহার দেন দর্শকদের। ১৯৪৯ সালে দিলীপ কুমার মেহবুব খানের 'আন্দাজ' ছবিতে অসাধরণ চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর সঙ্গে সহ-অভিনেতা ছিলেন রাজ কাপুর ও নার্গিস। এই ছবিও দারুণ সফলতা পায়। ওই একই বছরে বক্স অফিস আরও একটি হিট ছবি শবনম পায়, যেখানে দিলীপ কুমার অভিনয় করেছিলেন। এরপর আর থেমে থাকেননি তিনি। জোগান, বাবুল, হলচল, দিদার, তরানা, দাগ, উড়ান খটোলা, ইনসানিয়াত, নয়া দৌড়, মধুমতি, পয়গাম, দেবদাস, আন, আজাদ, কোহিনুর, গঙ্গা যমুনা, রাম অউর শ্যাম, শক্তি, ক্রান্তি, সওদাগর সহ ৬৫-টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। বলিউড এই কিংবদন্তী অভিনেতাকে 'ট্র্যাজেডি কিং' তকমা দিয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
বড় পর্দার ট্র্যাজেডি কিং-এর ব্যক্তিগত জীবন ছিল যথেষ্ট রঙীন। প্রথমে দিলীপ কুমার, অভিনেত্রী কামিনী কৌশলের প্রেমে পড়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা বিয়ে করতে পারেননি। পরবর্তীকালে তিনি রোমাঞ্চকরভাবে অভিনেত্রী মধুবালার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, কিন্তু তাঁদের পরিবার এই বিয়েতে রাজি হননি। এরপর দিলীপ কুমার ১৯৬৬ সালে তাঁর চেয়ে ২২ বছর কম বয়সী সৌন্দর্য্যের রানী অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন। তবে আটের দশকের গোড়ায় কিছুটা হলেও ঝড়ের মুখে পড়েছিল তাঁদের দাম্পত্য। পাকিস্তানের নাগরিক আসমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন দিলীপকুমার। এমন শোনা যায়, তিনি সায়রা বানুকে ডিভোর্স করে বিয়ে করেছিলেন আসমাকে। তবে এরপর দিলীপ কুমার তাঁর বাকি জীবন সায়রা বানুর সঙ্গেই কাটান।
পুরস্কার ও সম্মান
দিলীপ কুমারকে ব্যাপকভাবে হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি একজন ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুরস্কার বিজয়ী হওয়ার জন্য গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের জায়গা দখল করে নেন। তিনি তার অভিনয় জীবন জুড়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে ৮ বার ফিল্মফেয়ারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার সহ ১৯ বার ফিল্ম ফেয়ারে মনোনয়ন পেয়েছেন। দিলীপ কুমারকে ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মান দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়।
দিলীপ কুমারের মৃত্যু
হিন্দি চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেওয়ার পর দিলীপ কুমার প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। তাঁকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছিল। বয়সজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবে সবসময় পাশে ছিলেন সায়রা বানু। তবে দীর্ঘ অসুস্থতার পর বুধবার সকালে প্রয়াত হন দিলীপ কুমার। বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। গত বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থতার জেরে মুম্বইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। এদিন সকালে সেখানেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মূলত, শ্বাসকষ্টের সমস্যার জেরেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল তাঁকে। বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। গত মাসেই জানা গিয়েছিল বর্ষীয়ান অভিনেতার ফুসফুসে জল জমেছে।