মোদি সাবধান! ২০১৯-এ কিন্তু দিদি আপনাকে প্রবল চ্যালেঞ্জ দিতে চলেছেন
২০১৬ সালটি মমতা বন্দ্যপ্যাধ্যায়ের পক্ষে বেশ শুভ দেখাচ্ছে। প্রথমত তো চিরশত্রু বামেদের বিনাশ করলেন, দোসর কংগ্রেস সহ। তারপরে এল সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় যা প্রকারান্তরে বাম সরকারের বাকি লেশটুকুকেও নিশ্চিহ্ন করল। আর তিন নম্বর খুশির খবর এল যখন নির্বাচন কমিশন মমতার অষ্টাদশী তৃনমূল কংগ্রেসকে জাতীয় দলের মর্যাদা দিল। সব মিলিয়ে দিদির এখন যাকে বলে মাহেন্দ্রক্ষণ। অবশ্য এই তিনটি ঘটনা যে শুধুমাত্র তৃণমূল নেত্রীর ব্যক্তিগত বা রাজ্যস্তরে বড় কোনো রাজনৈতিক জয়, তা নয়। এই ঘটনাগুলি ভারতের জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ সমীকরণের একটি বিশেষ নির্দেশকও বটে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গত প্রায় আড়াই মাসে কিন্তু জাতীয় স্তরে আর কোনো বিকল্প নেতৃত্ব দেখা যায় নি। কংগ্রেস-এর ধারাবাহিক পতন এবং গাঁধী পরিবারের ব্যর্থতা যেমন একদিকে বিজেপিকে আরও মজবুত করেছে, তেমনই আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে থেকেও কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে কাউকে উঠে আস্তে দেখা যায় নি। তার একটি বড় কারণ অবশ্যই কেন্দ্রে এনডিএ-র সংখ্যাগুরু সরকার। ফলে ভারতের রাজনীতিতে এখন একটি 'মোদি বনাম বাকিরা' সমীকরণ গুরুত্ব পাচ্ছে।
এই রাজনৈতিক মডেলটির (ইন্দিরা গাঁধীর পর এই ব্যবস্থা আর বিশেষ প্রকাশ পায়নি আমাদের দেশে) একটি বিশেষ দিকও রয়েছে। মোদি যেমন কেন্দ্রে একাই শাসন করছেন তাঁর দল এবং সরকারকে, তেমন ভাবে কিন্তু রাজ্যস্তরে সাফল্য পাননি। গত লোকসভা নির্বাচনের বিপুল জয়ের পর বিজেপি কয়েকটি রাজ্য জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে সে সবকটিই জয়ই এসেছিল কংগ্রেস-এর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, যেখানেই কংগ্রেস সরকারে ছিল, সেখানেই বিজেপি জিতেছে (এমনকি এবছর অসমেও তারা কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যূত করে সিংহাসনে বসে)। কিন্তু যেসব রাজ্যে কোনো অ-কংগ্রেসি দল ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানে কিন্তু বিজেপি ডাহা ফেল। তা সে মমতাই হন, বা তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, ওডিশার নবীন পট্টনায়েক, বিহারের নীতিশ কুমার-লালুপ্রসাদ জুটি বা দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল -- মোদি বা তাঁর বিজেপি এঁদের কাউকেই এখনো পর্যন্ত হারাতে পারেননি। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটাকে যাকে বলে একটি 'স্টেলমেট' অবস্থা।
কিন্তু এইমুহূর্তে একজন আঞ্চলিক নেত্রী এই 'স্টেলমেট' ভেঙে মোদিকে আগামীদিনে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখেন এবং তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন, তা বুঝতে হলে আবার ফিরতে হবে ওই তিনটি বড় সাফল্যের কাহিনীতে।
বাংলায় রাজনৈতিকভাবে মমতার আর পাওয়ার কিছু নেই
মমতাকে আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতে এক বড় ভূমিকা পালন করতে দেখা যেতে পারে কারণ রাজ্যস্তরে ওনার আর কিছু পাওয়ার নেই। গত কয়েকবছর যাবৎ বামেদের ক্রমাগত হারাতে হারাতে এবছর বলতে গেলে একা হাতেই বাম-কংগ্রেস জোটকে ধরাশায়ী করেন মমতা। এবছরের জয়টি নিঃসন্দেহে আরও বড় কারণ বামপন্থীদের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী আদতে পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত কাস্তে-হাতুড়ি-হাত-মার্কা বামপন্থারও পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দিয়েছেন। এই রাজ্যে আর মমতার কিছু নতুন করে কিছু করার নেই, অন্তত রাজনৈতিক ভাবে।
সুপ্রিম কোর্টের রায় আর 'আমি তোমাদেরই লোক'
দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের রায়। সিঙ্গুরের মোটরগাড়ির কারখানার জন্যে জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ছিল, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় তৃণমূল নেত্রীর কাছে এক বিরাট জয় - রাজনৈতিক, মনঃস্তাত্বিক সব দিক দিয়েই রাজনৈতিক কারণ সেই সময় টাটাদের এই ন্যানো গাড়ির কারখানার সর্বাধিক বিরোধিতা করেন মমতাই। নিজের গরিব-বন্ধু প্রতীকটিকে দৃঢ় করতে তিনি সেইসময় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আম সমর্থক খুশি হলেও বাঙালি মধ্যবিত্ত তাতে খুশি হয়নি একটুকুও, তা মমতা জানতেন ভালোভাবেই। তাই, সেই ঘটনার এক দশক পর যখন উনি নিজেই মুখ্যমন্ত্রী, তখন সুপ্রিম কোর্টের রায় আস্তে না আসতেই উনি টাটাদের ফের নিমন্ত্রণ করলেন বাংলায় ফিরে আসার জন্যে। এবং সেটা করলেন যেখানে সেখানে নয়, জার্মানির মিউনিখ শহরে দাঁড়িয়ে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে মমতার মতো পোড়খাওয়া নেত্রী চাননি।
একদিকে আদালতের রায়কে সাধুবাদ জানিয়ে দেখালেন যে ক্ষমতায় আসার পরও উনি মানুষ হিসেবে গরিব-বান্ধবই রয়েছেন, আবার টাটাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে ক্ষুব্দ্ধ মধ্যবিত্তকেও জানাতে চাইলেন যে প্রশাসক হিসেবে উনিও চান যে বঙ্গে শিল্পের ফোয়ারা ছুটুক। একদিকে যখন মোদিকে তাঁর সমালোচকরা 'সুট-বুট' সরকারের কান্ডারি হিসেবে প্রায়ই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, সেখানে মমতার এই উল্টোদিকে হেঁটে 'দীনবন্ধু' হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করার প্রয়াস আগামী দিনে তাঁর দিকে পাল্লা অনেকটাই ভারী করতে পারে। আর কংগ্রেস যেভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, তাতে মোদি-বিরোধী শক্তি একজোট হলে তা মমতার নেতৃত্বাধীনেই হওয়ার সম্ভনা বেশি, তা নীতীশ, মুলায়ম, লালুর মতো রাজনীতিবিদরা খুব ভালোভাবেই জানেন। তাছাড়া মোদির 'হিন্দুত্ববাদী' পরিচয়ের পাশাপাশি মমতার 'সেকুলার' প্রতীক তো আছেই।
জাতীয় দলের তকমা
তৃতীয় কারণটিও বড়, অন্তত একজন আঞ্চলিক নেত্রীর কাছে তো বটেই। এবং সেটা হল তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় দলের তকমা পাওয়া। এব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সমস্ত আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দকে যে পিছনে ফেলে দিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। আগামী তিন বছর যদি মমতা একটি বা দুটি রাজ্যেও কিছু করে দেখতে পারেন অনুষ্ঠানিকভাবেও, তাহলেও ২০১৯ সালের লোকসভার লড়াইতে উনি মোদিকে অনেকটাই মনস্ত্বাত্বিক চাপে ফেলে দিতে পারবেন। আর তাছাড়া মমতা জাতীয় রাজনীতিতে নতুন নন, বরং মোদির থেকেও তাঁর নয়াদিল্লির অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। বহু মন্ত্রক তিনি আগে সামলেছেন, সাংসদ হিসেবেও কাজ করেছেন। সুতরাং একষট্টি-বছর বয়সী মমতা যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে অনেক গুছিয়ে আক্রমণে যাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১৬ সালে আরও একবার বঙ্গজয়ের পর উনি এখন অনেক পরিশীলিত রাজনীতিবিদ। জাতীয় মঞ্চের লড়াইতেও তাঁকে এইরূপেই দেখতে চাইবেন আপামর বঙ্গবাসী।