মুছে দাও সব কালো, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে জ্বালাও আলো, চমক দিতে তৈরি নরেন্দ্রপুর গ্রিন পার্ক
যেখানে কালো, সেখানেই আলো। আর এই আধারেই আলো জ্বালাতে এখন মহা প্রস্তুতিতে মেতেছে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন। সমাজের বুকে এখনও নিপীড়িত মহিলারা।
যেখানে কালো, সেখানেই আলো। আর এই আধারেই আলো জ্বালাতে এখন মহা প্রস্তুতিতে মেতেছে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন। সমাজের বুকে এখনও নিপীড়িত মহিলারা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীমুক্তি নিয়ে মুখে অনেক কথা বললেও বাস্তবে ছবিটার কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আজও পণের জন্য বলি হতে হয় নারীকে। এখনও পুরুষদের চোখে লালসার শিকার একাকী নারী। সংসার ধর্ম পালনের জন্য কর্মরতা নারীকে বাধ্য করা হয় তাঁর অফিস-কাছারি বন্ধ করতে। বহু পরিবারে আজও নারী সেভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করাই সুযোগ পান না।
নারীদের বঞ্চনার এই দিকটিকে তুল ধরতেই এবার এক অসামান্য থিম-কে তাদের পুজোর আধার করেছে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটি। যার নাম 'মুছে দাও সব কালো, আমার উমার ঘরে এলো'। এখানে উমা-র দৈবিক শক্তি যেমন প্রকাশ পাচ্ছে তেমনি থাকছে তার মানবী রূপ। আর এই মানবীরূপেই সংসারে থাকা সমস্ত অত্যাচারী পুরুষদের ধ্বংস করবেন উমা। এই অত্যাচারি পুরুষদের তুলনা করা হচ্ছে অসুরদের সঙ্গে।
সমাজের বুকে নারী বঞ্চনার এমন বিষয়কে থিম করার ভাবনা কীভাবে রূপায়িত হল? প্রশ্নের উত্তরে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস জানালেন, দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মা-উমার ছেলে-মেয়ে এবং পোষ্যদের সঙ্গে করে পিতৃগৃহে আগমনের কাহিনি। এই কাহিনি আসলে আমাদের সমাজের বুকেরই একটা সূত্র। বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েটা কবে ঘরে ফিরবে সে আশায় পথ চেয়ে থাকে মা। আর সেই মেয়ে যখন বাপের বাড়ি ফেরে তখন মা-এর মন আনন্দে ভরে ওঠে। কিন্তু, এই মা-মেয়ের সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে থাকে এক বঞ্চনা ও অবহেলার কাহিনি। যে কাহিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির। সময় এগিয়েছে, হাইটেক লাইফে সেজেছে জীবন। কিন্তু, নারীদের প্রতি পুরুষদের মনোভাবে খুব একটা বদল আসেনি। তাই নরেন্দ্রপুর গ্রিন পার্ক সর্বজনিন-এর থিম 'মুছে দিয়ে সব কালো, আমার উমা ঘরে এলো'।
দুর্গাপুজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ জানালেন, 'এই ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে আস্ত একটা মন্দির কমপ্লেক্স তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ভৈরব-ভৈরবীদের মন্দিরের সঙ্গে একদম কেন্দ্রে থাকছে এমন এক ঘর যার নাম উমা। এই ঘরে মানবরূপিনী উমা তাঁর নারীশক্তি দিয়ে বধ করবেন অশুভ শক্তির প্রতীক অসুরের দলকে। রক্তাক্ত এক প্রলয়ঙ্কর পরিবেশের মাঝে স্নিগ্ধ-শান্ত রূপে উমা। এই মন্দির কমপ্লেক্সে-ই থাকছে বনবিবির মন্দির। এই মন্দির সর্বধর্ম সমন্বয়-এর প্রতীক। কারণ বনবিবি যেমন হিন্দুদের দ্বারা পূজিত হন, তেমনি মুসিলমরাও এর আরাধনা করেন। উমার ঘরের পিছনেই তৈরি করা হয়েছে আরও এক মন্দির দালান। যেখানে অধিষ্ঠাত্রী হবেন মা দুর্গা-র মহিষাসুর-মর্দিনী রূপ। এই মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যেই থাকবে চণ্ডী, মনসা-র মন্দিরও।'
সবমিলিয়ে প্রতি বছর যেভাবে দুর্গাপুজোয় নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক চমক দিয়ে আসছে এবারও তার অন্যথা হচ্ছে না। এমনটাই জানালেন সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস। এই বছর নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব-এর ৫৯তম বর্ষ। পুরো থিম-কে ফুটিয়ে তোলার কাজ কাজ করছেন প্রদীপ মণ্ডল। প্রতিমা করছেন অরুণ পাল। গতবছর নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন-এর থিম ছিল লোহা-লক্কর। সেই মণ্ডপ যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে সাড়া ফেলেছিল তেমনি কলকাতার পুজোগুলোকেও কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিল। ২০১৬ সালে এইখানে দুর্গাপুজোয় থিম ছিল 'মহাবিদ্যা'।
নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটির পুজো বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রশংসিত হচ্ছে। যার জন্য জেলার সেরা সম্মান, সোনারপুর থানার সেরা পুজোর সম্মান, নারীশক্তি শারদ সম্মান, তন্তুজ শাড়ি সেরা সম্মান-এর মতো পুরস্কারেও ভূষিত হয়ে আসছে। সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস জানালেন, ততীয়াতেই পুজোর উদ্বোধন করবেন পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। এছাড়াও সেদিন উপস্থিত থাকবেন স্থানীয় বিধায়িকা ফিরদৌসী বেগম, সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার এমআইসি নজরুল আলি মণ্ডল। ফিরদৌসী বেগম আবার এই পুজোর প্রেসিডেন্ট। নজরকাড়া পুজোর আয়োজনে তাঁর অবদানও অনস্বীকার্য। এছাড়াও এই পুজোর সঙ্গে মেন্টর হিসাবে জড়িয়ে আছেন নজরুল আলি মণ্ডল। এই অতিথি সমাবেশের সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয়ার দিন পুজোর উদ্বোধনে উপস্থিত থাকবেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, জাভেদ খান। থাকবেন পুজোর থিম সঙ-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র উমা-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আবার বসন্ত বিলাপ-এর নায়িকা দেবলীনা কুমারও।
[আরও পড়ুন:হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে দেবী পূজিত হন বাঁকুড়ার মল্লরাজবাড়িতে]
ফি বছরই নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটি সেরা পুজো উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে সাধারণ মানুষকে। এবারও তার অন্যথা হবে না বলেই মনে করছেন নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস। এইবারের পুজোর আরও এক আকর্ষণ নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্কের মধ্যে গঙ্গার ঘাট। বারাণসীর গঙ্গার ঘাটের কিছুটা ছোঁয়া থাকবে এখানে। থাকবে কিছু সুসজ্জিত নৌকা। মানে মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার ফিলিং-দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন বিশ্বজিৎ। এর জন্য নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্কের একটি পুকুরকে সাজিয়ে তোলার কাজও চলছে।
[আরও পড়ুন:চার নয়, পূর্ব কলকাতার দাস পরিবারের পুজো হয় ১৭ দিন ধরে]
নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্কের পুজো মানে সে উৎসব চলে একাদশী পর্যন্ত। দ্বাদশীতে বিশাল শোভাযাত্রা করে হয় প্রতিমা নিরঞ্জন। তৃতীয়া থেকেই এবার এইখানে পুজো শুরু হয়ে যাবে। পুজোর এই কটাদিন নানা ধরনের সাংস্কতিক সন্ধ্যার আয়োজন এবং কর্মসূচি নিয়ে থাকে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটি। এবারও তার অন্যথা হচ্ছে না। লোকসঙ্গীত শিল্পের আসরের সঙ্গে সঙ্গে থাকছে নৃত্য ও আধুনিক গানের আসর। প্রতিবছরের মতো এবারও গরিবদের বস্ত্র-বিতরণের কর্মসূচিকেও পুরোদমে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্বজিৎ।
[আরও পড়ুন:বাংলার লুপ্তপ্রায় শিল্প নিয়ে ত্রিধারা সম্মেলনীর থিম 'সাজাবো যতনে, প্রকৃতি রতনে']
কী ভাবে পৌঁছবেন নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটির প্রাঙ্গণে? যারা কলকাতা থেকে যাবেন তাদেরকে কোনওভাবে কামালগাজি মোড়ে পৌঁছতে হবে। এইখান থেকে যে রাস্তাটি সরাসরি সোনারপুরের দিকে গিয়েছে তাতে প্রবেশ করতে হবে। আধ কিলোমিটারের মধ্যে হাতের ডানদিকে পড়বে নেতাজি স্পোর্টিং কমপ্লেক্স। এটা পার করে একটু এগোলেই হাতের ডানদিকে পড়বে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব-এর গেট। ফি বছর এই পুজো দেখতে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। এবারও এই ভিড়ের অঙ্কটা বাড়বে বলেই মনে করছে নরেন্দ্রপুর গ্রিনপার্ক সর্বজনিন দুর্গোৎসব কমিটি।