লতা-সন্ধ্যা সুখ-দুঃখের গল্পে মাততেন সময় হলেই! দ্বৈরথ-তিক্ততার জলাঞ্জলি দুই ‘সরস্বতী’র
লতা-সন্ধ্যা সুখ-দুঃখের গল্পে মাততেন সময় হলেই! দ্বৈরথ-তিক্ততার জলাঞ্জলি দুই ‘সরস্বতী’র
একজন ভারতের সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী, অন্যজন বাংলার সঙ্গীত জগতের মহারানি। দুজনের কণ্ঠেই যেন স্বয়ং সরস্বতী বাস করেন। একজন লতা মঙ্গেশকর, অন্যজন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। দুজন কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন ছিল, তা নিয়ে কম গসিপ হয়নি। কিন্তু সত্যিই কি তাঁদের মধ্যে কোনও সুসম্পর্ক ছিল না। সম্প্রতি লতা-সন্ধ্যার যে ফোনালাপ সামনে এসেছে, তা শুনতে কে বলবে দুই শিল্পীর মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল না।
মুম্বইয়ে সন্ধ্যার কেরিয়ার ও লতা
লতা ও সন্ধ্যা- উভয়েই দুই ভিন্ন জগতের অধিষ্ঠাত্রী। যে যাঁর জগতে সেরা। তাঁদের মধ্যে যেমন পারস্পরিক সম্মান ছিল, ছিল শ্রদ্ধার সম্পর্ক। অথচ সঙ্গীত জগতে কান পাতলেই শোনা যায় সন্ধ্যা-লতাকে নিয়ে নানা কথা। মুম্বইয়ে সন্ধ্যার কেরিয়ার নাকি শেষ করে দিয়েছিলেন লতা। লতার কুচক্রীপনার কারণেই মুম্বইয়ে জায়গা পাননি সন্ধ্যা। তবে বাংলা সঙ্গীত জগতে সন্ধ্যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন সেরার আসনে।
সন্ধ্যা ও লতার বিস্তর মিল
দুই সঙ্গীত শিল্পীই প্রায় সমবয়ষ্ক। দুজনেরই বয়স ৯০-এর উপরে। লতার ৯২, আর সন্ধ্যার ৯০। উভয়েই দুই ভিন্ন জগতে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। আবার অসুস্থও হন উভয়ে একইসঙ্গে। লতা মঙ্গেশকর মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সন্ধ্যা মুখ্যোপাধ্যায় এখনও লড়াই চালাচ্ছেন কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে অনেকাংশে অমিলও ছিল।
দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর প্রথম পরিচয় ও সম্পর্ক
লতা মঙ্গেশকর ভারতরত্ন-সহ ভারত সরকারের সমস্ত পুরষ্কার পেলেও সন্ধ্যা মুখ্যোপাধ্যায়কে ৯০-এর কোটায় এসে পদ্মশ্রী দেওয়ার সুপারিশ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। অপমানে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন গীতশ্রী। তারপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আজ লতা মঙ্গেশকর ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর প্রয়াণের দিনে দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর প্রথম পরিচয় ও সম্পর্ক নিয়ে পুরনো নানা গল্পগাথা উঠে এল।
শচীনদেব বর্মনের ডাকে সাড়া দিয়ে বোম্বেতে সন্ধ্যা
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শচীনদেব বর্মনের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বইয়ে। প্রথম বাংলা ছেড়ে যাবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেনষ অনেক অনুরোধ-উপরোধে তিনি মুম্বইয়ে যান। স্বংয় শচীন কর্তা ডাক পাঠিয়েছেন বলে কথা। তার আগে শচীন-জায়া মীরা দেব বর্মনকে গান শুনিয়ে এসেছিলেন সন্ধ্যা।
লতা ও সন্ধ্যার যুগলবন্দি মুম্বইয়ের গানের জগতে
তবে মুম্বইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) গিয়ে তিনি প্রথম শচীনদেব বর্মনের ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পাননি। তিনি গেয়েছিলেন অনিল বিশ্বাসের ছবি তারানায়। সেখানে লতার সঙ্গে ডুয়েট ছিল সন্ধ্যার। মধুবালার লিপে লতা আর শ্যামার লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বোল পাপিয়ে বোল রে- গানে লতা ও সন্ধ্যার যুগলবন্দি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। সেই লতার সঙ্গে আলাপ। তারপর উভয়ের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়তে থাকে।
লতা ও সন্ধ্যার গল্পে বন্ধুত্বের সম্পর্ক
দুই পরিবারের মধ্যে যাতায়াত শুরু হয়। লতা মঙ্গেশকর প্রায়ই সন্ধ্যার বাড়িতে চলে যেতেন। সেখানে দুই শিল্পী গান নিয়ে আলোচনা করতেন। সন্ধ্যার মায়ের হাতের রান্না খুব পছন্দ করতেন লতা মঙ্গেশকর। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মায়ের হাতে পায়েস খেয়ে যেতেন। খুব পছন্দ করতে বাঙালি তরি-তরকারি। আবার উল্টোটাও হত, সন্ধ্যাও যেতেন লতার বাড়িতে। লতার মা সন্ধ্যাকে খুব ভালোবাসতেন। এভাবেই দুজনের মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
লতার প্রতি শ্রদ্ধা অনেকাংশ বেড়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার
লতা কখনও একা আসতেন, কখনও অন্যান্য সুরকারদের নিয়েও আসতেনষ লতা-সন্ধ্যা গান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হত। কখনও বিছানায় শুয়ে দুজনে গান নিয়ে আলোচনা করতেন। লতা মঙ্গেশকর শোনাতেন তাঁর বলিউডের জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার গল্প। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি কীভাবে নিজে জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন, সেই গল্প শুনে লতার প্রতি শ্রদ্ধা অনেকাংশ বেড়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার।
তিক্ততা তো নয়ই, লতা-সন্ধ্যার দ্বৈরথও ছিল না
কত কষ্ট করে বলিউডে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন লতা। ছেঁড়া চটি, মাত্র দুটি শাড়ি। বালিশের নীচে রেখে ইস্ত্রি করা- এমন নানা গল্প। আবার লতার লম্বা চুলের যত্ন নিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজে হাতে তেল মাখিয়ে দিয়েছেন, সেইসব ছোটো ছোটো কাহিনি শোনার পর কে বলবে উভয়ের সম্পর্ক তিক্তায় ভরা ছিল। পরবর্তীকালে লতা যখন বাংলায় এসেছেন সন্ধ্যার বাড়িতে গিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই তাঁজদের ফোনে কথা হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ দুই শিল্পীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। একে অপরকে গান শুনিয়েছেন। এমনটা সম্পর্ক যাঁদের, তাঁদের কি কোনও তিক্ততা থাকতে পারে! তবু অনেক মানুষের ধারণায় রয়েই গিয়েছে লতা-সন্ধ্যা দ্বৈরথ ছিল।