১০২২ বছর পুরনো বিষ্ণপুরের এই পুজোয় জড়িয়ে মল্ল রাজাদের ইতিহাস
এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের ইতিহাস।
এই পুজো ১০২২ বছরের পুরানো। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের ইতিহাস। জড়িয়ে আছে সাধারণ মানুষের আবেগ। মল্লরাজাদের এই রাজধানীতে অনেকগুলি সর্বজনীন দুর্গাপুজো হলেও এই পুজো সবদিক দিয়ে অনন্য।
তাই দীর্ঘদিনের প্রথা মেনে জিতাষ্টমীর দিন শুরু হয়ে গেল এই মন্দিরের পুজো। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের পরিবারের এই পুজো চলবে আঠারো দিন ধরে। অতীতের আড়ম্বর না থাকলেও পুজোর আচার, আচরণে, নিয়মে বা ঐতিহ্যে ভাটা পড়েনি এতটুকুও। পুরানো রীতি মেনেই রাজপরিবারে ঠাকুর দালানে দেবীর পুজোর আয়োজন করেন এই পরিবারের সদস্যরা।
রবিবার সন্ধ্যায় হয়েছে বিল্ববরণ। সোমবার, জিতাষ্টমীর দিন আনা হয়েছে বড় ঠাকরুণকে। নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছে ৯টি তোপধ্বনি। এখানে আঠারো দিন ধরে পুজো হয়। এখানে পুজিতা দেবী মৃন্ময়ী, মল্লরাজাদের কুলদেবী।
মা মৃন্ময়ী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন মল্লরাজ জগত মল্ল। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে। কথিত আছে যে আগে মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদুম্ননগর। এই পরিবারের ১৯তম রাজা জগত মল্ল ৯৯৪ সালে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন বিষ্ণুপুরে। ৯৯৭ সালে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।
গঙ্গা মাটির তৈরি বিগ্রহ সেই সময় থেকেই পুজিতা এখানে। সেই সময় পুজোর জৌলুস ছিল আকাশচুম্বি। অন্যান্য জায়গায় কালিকাপুরাণ মতে পুজো হলেও একমাত্র বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির দুর্গা পূজা হয় বলি নারায়ণী মতে। আগে এই পুজোতে বলির প্রচলন থাকলেও মল্লরাজা হাম্বীর বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বলিদান প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
সেই সময় থেকেই শব্দকে ব্রহ্ম রূপে দেখার শুরু। চালু হয় তোপধ্বনি দেওয়ার রীতি। সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখে আজও দুর্গাপুজার দিনগুলিতে নির্ঘণ্ট মেনে গর্জে ওঠে কামান।
এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পট পুজো। বড় ঠাকরুণ, মেজ ঠাকরুণ ও ছোট ঠাকরুণ নামের তিনটি পট আনা হয়। মন্দিরে দেবী প্রতিমার পাশে তিনটি নির্দিষ্ট জায়গায় পুজো হয় তিনটি পটের। বড় ঠাকরুণ এর ক্ষেত্রে মহাকালী, মেজ ঠাকরুণ এর ক্ষেত্রে মহালক্ষ্মী, ছোট ঠাকরুণ এর ক্ষেত্রে মহা সরস্বতী স্ত্রোত্র পাঠ করা হয়।
জিতাষ্টমীর দিন আনা হয়েছে বড় ঠাকরুণকে। দেবীপক্ষের চতুর্থীতে শুরু হয় মেজ ঠাকরুণের পুজো । আর মহাসপ্তমীর দিন নিয়ে আসা হয় ছোট ঠাকরুণকে। বিষ্ণুপুরে অনেক গুলি পুজো হলেও এই পুজোর সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য ও আবেগ। ঐতিহ্য বজায় রেখে অষ্টমীর পুজো হয় ধুমধাম করে। কামানের গর্জনে আরম্ভ হয় সন্ধিপুজো।
সেই গর্জন শোনার পর এলাকার অন্যান্য পুজোর সন্ধিপুজো শুরু হয়। এখন কামান অনেক ছোট হয়েছে। মন্দিরের সংলগ্ন একটি টিলার ওপর এই কামান ফাটানো দেখতে আজও হাজির হন অনেকে। অষ্টধাতুর নির্মিত বিশালাক্ষী দেবীর পুজো হয় অষ্টমীর দিন। সন্ধিক্ষণে সোনার তৈরি চাঁপা ফুল দিয়ে অঞ্জলি দেন পরিবারের সদস্যরা।
বিজয়া দশমীর দিন মা মৃন্ময়ীর ঘট বিসর্জনের পর তিন ঠাকরুণের ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর পটগুলি চলে যায় রাজবাড়ির অন্দরে। রাজ পরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর জানান জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তারা এই পুজার ঐতিহ্যে ভাটা পড়তে দেননি। পুজোর জন্য কিছু অনুদান দেয় বিষ্ণুপুর পুরসভা। পরিবারের সম্পত্তি থেকে আসে কিছু টাকা। বাকি খরচ বহন করেন পরিবারের সদস্যরা।
[জল সংরক্ষণের বার্তা নিয়ে মণ্ডপ সাজিয়েছে রামচন্দ্রপুর মিলন সঙ্ঘ]