Exclusive: টোকিওয় ভারতীয় হকির সাফল্যে উচ্ছ্বসিত গুরবক্স, আনন্দেও আক্ষেপ বীর বাহাদুরের
গুরবক্স সিং ও বীর বাহাদুর ছেত্রী। প্রথমজন ১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিক হকিতে সোনাজয়ী ভারতীয় দলের সদস্য, ১৯৬৮ সালে ভারতের যুগ্ম অধিনায়ক ছিলেন এবং ব্রোঞ্জ জেতেন। ১৯৭৬ সালে বীর বাহাদুর ছেত্রীরা যেবার কানাডার মন্টরিয়ালে হকিতে সপ্তম স্থান পান, সেই দলের কোচ ছিলেন গুরবক্স সিং। ভারত শেষ অলিম্পিক পদক জিতেছিল ১৯৮০ সালে। সেই দলের গোলকিপার ছিলেন বীর বাহাদুর ছেত্রী। ৪১ বছর পর ভারতীয় হকি দলের পদকের খরা মেটার পর দুজনেই উচ্ছ্বসিত। ওয়ানইন্ডিয়া বাংলার সঙ্গে কথা বলার সময় দুজনেই জানালেন, ভারতীয় মহিলা দলও আগামীকাল ব্রোঞ্জ জেতার বড় দাবিদার।
উচ্ছ্বসিত গুরবক্স
গুরবক্স সিং বলেন, নিঃসন্দেহে এটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বলা ভালো, ভারতীয় হকির গৌরবের সোনালি অধ্যায় নতুনভাবে শুরু হল। তবে এটা ধরে রাখতে হবে। আশা করি, দর্শকরা আরও বেশি আগ্রহ দেখাবেন। স্পনসররা এগিয়ে আসবেন, সংবাদমাধ্যমকেও আগ্রহটা দেখাতে হবে। দু মাস পর হকি ভুলে গেলাম সেটা না করলেই আগামী দিনে আরও বড় সাফল্য আসবে। সেমিফাইনালে হেরে যাওয়ার পর ব্রোঞ্জ জেতা কম কথা নয়। যেভাবে প্রথম কোয়ার্টারে পিছিয়ে পড়ে এবং দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ১-৩ গোলে পিছিয়ে পড়ে সমতা ফিরিয়েছে ভারত এবং তারপর এগিয়ে গিয়ে সেই লিড ধরে রেখে ব্রোঞ্জ জিতেছে সেটা দলের চারিত্রিক গঠন দারুণ না হলে সচরাচর হয় না। টিম স্পিরিট, দায়বদ্ধতা, একাগ্রতা, স্ট্যামিনা, স্ট্র্যাটেজি এবং সর্বোপরি চার্ডজ আপের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
সামগ্রিক খেলা নিয়ে
মনপ্রীত সিংয়ের অধিনায়কত্বের প্রশংসা করলেও গুরবক্স সিং মনে করেন, দলগত সংহতিতেই এই জয় সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া এখন বিশ্বের হকি যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে একক কৃতিত্বের চেয়েও দলগত সংহতিতেই সাফল্য আসছে। গুরবক্স সিং বলেন, ভারতের পুরুষ হকি দল অলিম্পিকে শুধু হেরেছে অস্ট্রেলিয়া ও বেলজিয়ামের কাছে। দুটি দলই বিশ্ব ক্রমতালিকায় আমাদের উপরে। আমাদের নীচে থাকা কোনও দলের কাছে ভারত হারেনি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেলজিয়াম আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত এবং অভিজ্ঞ। তবু আমরা বেলজিয়ামের বিরুদ্ধেও ভালো খেলেছি। আজও দারুণ ফাইটব্যাক করে জিতেছি। সেমিফাইনালে হারার পর ফের রি-গ্রুপ হয়ে এমন জয় দারুণ স্ট্যামিনারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জয়ের সঙ্গে তুলনা
ভারত ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকের হকিতে যে বছর সোনা জেতে সে বছর অংশ নিয়েছিল ৬টি দেশ। বিশ্বের বড় অনেক দেশই বয়কট করেছিল অলিম্পিক। রাউন্ড রবিন পর্যায়ে জেতার পর প্রথম দুটি দলের মধ্যে হয়েছিল ফাইনাল। তবে গুরবক্স বলেন, যে দল অলিম্পিকে সোনা জিতেছে তার কৃতিত্ব খাটো করা যায় না। বরং ১৯৭২ সালে বিশ্বের তাবড় দেশগুলির মধ্যে থেকেই ভারত অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছিল, এদিনের জয় সেটির সঙ্গেই তুলনীয়।
নজর কাড়লেন যাঁরা
গোলে শ্রীজেশ তো বিগত ২০ বছরে দেশের সেরা গোলকিপার বলেই আমি মনে করি। তবে সকলেই ভালো খেলেছে, এক বা দু-জনকে বেছে নেওয়া যায় না, তা ঠিকও হবে না। তবে অমিত রুইদাস বা সুমিত বিপক্ষের পেনাল্টি কর্নারের সময়ও যেভাবে ভয়ডরহীনভাবে বুক চিতিয়ে লড়ল, চার্ডজ আপ করল তা খুব ভালো লেগেছে। পিছিয়ে পড়েও যাঁরা গোল করেছেন তাঁদের যেমন ভালো বলব, তেমনই ভারতের ডিফেন্সও খুব ভালো খেলেছে। শ্রীজেশের না হয় সারা শরীরে গার্ড ছিল। কিন্তু ভারতের প্রত্যেকে যে সাহস দেখিয়ে লড়াই চালিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছে তা সত্যিই তারিফ করার মতো। একটা গ্রেট গেম দেখলাম আজ। কোচিং স্টাফেরও একইসঙ্গে প্রশংসা করতে চাই।
বীর বাহাদুরের প্রশংসা
১৯৮০ সালে ভারতের অলিম্পিক সোনাজয়ী দলের অন্যতম সদস্য গোলকিপার বীর বাহাদুর ছেত্রীও প্রশংসা করলেন মনপ্রীতের দলের গোলকিপার শ্রীজেশের। তিনি বলেন, আজ খুব গর্ব অনুভব করছি। গর্ব ভালো খেলে জেতার জন্য। করোনা পরিস্থিতিতে প্র্যাকটিস ব্যাহত না হলে হয়তো আমরা ফাইনালেই খেলতাম। মাঝে যে কী হলো! কিন্তু এই দলটা ফাইনালে খেলার মতোই। পিছিয়ে পড়েও দুরন্ত জয়। অলিম্পিক পদক জিততে এত বছর দেরি হল কেন অনেকেই জানতে চাইছেন। আমার মনে হয় মডার্ন গেমের সঙ্গে এতদিন আমরা মানিয়ে নিতে পারিনি। যেটা এখন পেরেছে ভারতের পুরুষ ও মহিলা হকি দল। খুব ভালো কম্বাইন্ড গেম খেলছে। প্লেয়ারদের মধ্যে বোঝাপড়া দারুণ ভালো। শ্রীজেশ তো আগের চেয়েও এখন অনেক ভালো খেলছেন। অনেক দিন পর ভারতীয় হকিকে খুব ভালো জায়গায় দেখছি।
বাংলার জন্য আক্ষেপ
তবে এরই মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য সরকারের তরফে জীবনকৃতী খেল সম্মানে ভূষিত বীর বাহাদুর ছেত্রীর আক্ষেপও রয়েছে। তিনি বলেন, আমি বা আমার মতো তো অনেকেই বাংলায় হকি খেলা শিখে, খেলে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছি। কিন্তু ভারতের পুরুষ বা মহিলা দলে বাংলার একজনকেও দেখতে না পেয়ে একটু হলেও মন খারাপ। বাংলাতেও হকির ভালো পরিকাঠামো গড়়ে তোলা যায়। আমাদের এখানে বড় সমস্যা অ্যাস্ট্রোটার্ফ নেই। তিন মাসের জন্য হকির মাঠ পাওয়া যায়। অ্যাস্ট্রো টার্ফ সল্টলেকে হলে সেখানেও সকলের যাওয়ায় অসুবিধা রয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক গরিব প্রতিভা তো উঠে আসবে। ফলে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে কোথাও হকির ভালো পরিকাঠামো হলে কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় দলে বাংলার কাউকেও দেখতে পারি। জানি না, সেটা সম্ভব কিনা।
মেয়েদের পদকের প্রতীক্ষা
গুরবক্স সিং ও বীর বাহাদুর ছেত্রী দুজনেই অত্যন্ত আশাবাদী পুরুষ দলের মতো মহিলা হকি দলেরও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ের ব্যাপারে। বীর বাহাদুর ছেত্রী বলেন, মেয়েদের হকি দলকে বিগত বহু বছরে এত ভালো খেলতে দেখিনি। এমনিতেই রানি রামপালরা সেমিফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা পিছিয়ে পড়েও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর যে মানসিকতা দেখছি তা খুব উল্লেখযোগ্য। ওপরে-নীচে উঠে-নেমে কোথায় কাকে কখন ডজ করতে হবে, পাস বাড়াতে হবে সব কিছুতেই দারুণ তালমিল। আবারও বলছি, করোনা বাধা হয়ে না দাঁড়ালে এই দুটো দলেরই যা খেলা দেখছি তাতে ফাইনালে ওঠা নিশ্চিতই ছিল। গুরবক্স সিংও একই কথার রেশ ধরে বললেন, মেয়েদের দল প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সকলে প্রার্থনা করি, যাতে রানিরাও ব্রোঞ্জ জিতে আমাদের চমকে দিতে পারেন। দলগত সংহতি মেয়েদের দলের সাফল্যেরও অন্যতম কারণ।