অপারেশন গঙ্গাজল: পুলিশের যে পাশবিক নির্যাতন স্তম্ভিত করেছিল পুরো ভারতকে
সতর্কতা: প্রতিবেদনটিতে কিছু বর্ণনা আছে যা কারো কারো জন্যে অস্বস্তিকর হতে পারে।
১৯৮০ সালের ভারত। বিহার রাজ্যের ছোটো একটি শহর ভাগলপুরের পুলিশ ছিঁচকে অপরাধীদের শিক্ষা দিতে নির্যাতনের যে পথ নিয়েছিল তাতে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল পুরো দেশতো বটেই, একই সাথে বাকি বিশ্বও।
প্রায় ৪০ বছর পর বিবিসির ইকনুর কৌর কথা বলেছেন 'অপারেশন গঙ্গাজল' নামে কুখ্যাত ঐ পাশবিক পুলিশী নির্যাতনের কিছু প্রত্যক্ষদর্শী এবং এক ভুক্তভোগীর সাথে।
ভাগলপুরের ঐ পুলিশী পাশবিকতা নিয়ে ২০১৭ সালে তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন অমিতাভ প্রসার। ১৯৮০ সালে তিনি ছিলেন বয়সে কিশোর, স্কুলের ছাত্র।
বিবিসির কাছে একদিনকার এক দৃশ্যের স্মৃতিচারণ করছিলেন মি. প্রসার।
"১৯৮০ সালে আমি একদিন স্কুলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম রাস্তায় একটি লোক যন্ত্রণায় ছটফট করছে এবং চিৎকার করে মানুষজনের কাছে সাহায্য চাইছে। আশপাশে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে, কিন্তু কেউই এগুচ্ছে না। কাছে গিয়ে দেখলাম মানুষটার দুটো চোখের জায়গায় গর্ত। দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে।"
"পরে শুনলাম পাশের থানার পুলিশ অ্যাসিড দিয়ে তাকে অন্ধ করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।।"
১৯৮০ সালে ভাগলপুরে অপরাধীদের ধরে এনে অন্ধ করে দেওয়ার যে নীতি স্থানীয় পুলিশ নিয়েছিল, তার শিকার ৩৩ জনের একজন ছিল ঐ ব্যক্তি।
অমিতাভ প্রসারের বয়স ছিল মাত্র ১৩।
"ঐ বয়সে তখন আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কত বড় ইস্যু ছিল এটি। আমরা শিশু কিশোররা তখন শুনতাম পুলিশ এলাকার একজন কুখ্যাত ডাকাতকে শাস্তি দিয়ে কী সাংঘাতিক ভালো কাজ করেছে। আমার মনে আছে লোকটি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল, আর মানুষজন যেন তার ঐ যন্ত্রণা দেখে মজা পাচ্ছিল।"
১৯৮০ সালের দিকে বিহারে অপরাধ বাড়ছিল। তা দমনে ভাগলপুরের পুলিশ বিচার-বহির্ভূত পাশবিক এক নির্যাতনের পথ নিয়েছিল।
সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিচারের জন্য আদালতে না পাঠিয়ে তাদের দুই চোখে অ্যাসিড ঢেলে সারাজীবনের মত তাদের অন্ধ করে দিচ্ছিল ।
এক তরুণ আইনজীবীর লড়াই
রামকুমার মিশ্র ছিলেন সে সময় ভাগলপুর আদালতের একজন তরুণ আইনজীবী। বিবিসিকে তিনি বলেন কীভাবে একদিন তিনি সেই ভয়াবহ নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারলেন।
"আমি একদিন আদালতে দেখলাম দুটো লোকের চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। শুনলাম তাদের দুজনের চোখ ফুটো করে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়েছে।"
"আমি দেখলাম তাদের দুই চোখেই গর্ত, এবং সেখান থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। তারা আমাকে বললো, পুলিশের সাথে একজন ডাক্তার ছিল যে তাদের চোখে সাইকেলের চাকার স্পোক ঢুকিয়ে দেয়। তারপর অ্যাসিড ঢেলে নিশ্চিত করে যে তারা অন্ধ হয়েছে।"
ঐ দুজনকে দেখার পর রামকুমার মিশ্র ভাগলপুরের সবগুলো পুলিশ স্টেশনে যান। সেখানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার এমন আরো মানুষকে দেখতে পান।
"১৯৮০ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে অগাস্ট মাস পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে, এবং সে সময় আমি নির্যাতনের শিকার অনেক মানুষকে দেখেছি।"
মি. মিশ্র নির্যাতনের শিকার এমন ৩৩ জনের পক্ষে মামলা লড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
স্পোক দিয়ে খুচিয়ে তারপর অ্যাসিড
প্রথম দিকে যে কজনকে এভাবে অন্ধ করে দেওয়া হয় তাদের একজন ছিলেন উমেশ যাদব। পুলিশ তাকে চুরির অভিযোগে ধরেছিল।
বিবিসিকে মি. যাদব বলেন সেদিনের কথা।
"তখন আমার বয়স ছিল ২০। একদিন আমি বাড়ির দিকে যাচিছলাম। হঠাৎ দেখলাম কজন পুলিশ আমাকে অনুসরণ করছে। ভয়ে আমি সাইকেল থেকে নেমে দৌড় দিলাম। একসময় পুলিশ আমাদের ধরে এমন মারা মারলো যে একসময় আমার প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ার জোগাড় হলো।"
এরপর তরুণ উমেশ যাদবকে থানায় নেওয়ার পর চোখ ফুটো করে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়।
"থানার ডেপুটি সুপার আমার চোখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছি। আমি ব্যথায় চিৎকার করতে করতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। "
ধরার পর সন্দেহভাজন অপরাধীদের কারাগারে নেওয়া হতো না সেসময়। ভাগলপুর পুলিশ শহরের এক কোনায় একটি ক্যাম্প তৈরি করেছিল। সেখানে একজন ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে তারা সেসব অপরাধীদের অন্ধ করে দিত।
আইনজীবী রামকুমার মিশ্র বলেন, কারাগারে আনার আগেই তাদের সন্দেহভাজন অপরাধীদের ভিন্ন ভিন্ন পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গিয়ে অন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
"তাছাড়া, অমরপুর নামে একটি এলাকায় অন্ধ করার জন্য একটি আলাদা ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল।"
চোখে 'গঙ্গার পবিত্র জল'
পুলিশের হাতে অন্ধত্বের শিকার উমেশ যাদব বলেন, তাকে অন্ধ করার পর আরো অনেককে একইভাবে অন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তাকে অন্ধ করার পরপরই আরো নয়জনকে ধরে আনা হয়েছিল এবং তারাও অন্ধ হয়ে যায়।
আইনজীবী মি মিশ্রের মত উমেশ যাদবও একই ব্যাখ্যা দিলেন। প্রথমে সাইকেলের চাকার স্পোক চোখে ঢুকিয়ে ফুটো করা হতো। তার সেই ফুটো দিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হতো।
উমেশ যাদব বললেন, অ্যাসিড চোখে ঢালার আগে পুলিশ বলতো 'এবার তোকে পবিত্র জল দেওয়া হবে।'
"তারা (পুলিশ) বলতো এই গঙ্গা জল দেওয়ার পর যন্ত্রণা কমে যাবে। আসলে তারা অ্যাসিড ঢালতো যাতে আমরা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাই।"
ভাগলপুর পুলিশ তাদের এই অমানবিক নির্যাতনকে ইতিবাচক ইমেজ দেওয়ার জন্য অভিযানের নাম দিয়েছিল 'অপারেশন গঙ্গাজল'।
"ব্যাপারটা এমন যেন পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে কোনো কিছু পবিত্র করা হয় তেমনি অ্যাসিড ব্যবহার করে পুলিশ সমাজ থেকে অপরাধ, অন্যায় ধুয়ে দিচ্ছে," বলছিলেন আইনজীবী রামকুমার মিশ্র।
১৯৮০ সালের মে মাসে ঐ আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠির সূত্র ধরে মামলা রুজু হয়ে তদন্ত শুরু হয়।
১৯৮৪ সালে বিহারের ৩০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
তবে এতদূর এগুতে অনেক ঝামেলা, হুমকি-ধমকি সহ্য করতে হয়েছে মি. মিশ্রকে।
"পুলিশ আমাকে অনেক হুমকি দিয়েছে। একদিন একদল পুলিশ আমাকে জোর করে একটি হোটেলে ঢোকায়। আমার দিকে রিভলবার তাক বলে একজন বলে, তোমাকে এখন মেরে ফেলবো। আমি বললাম ঠিক আছে মেরে ফেল।"
"আমার স্ত্রী সবসময় খুব উদ্বেগে থাকতো। আমাকে বলতো - তুমি করছো কী। কেন করছো। শুধু আমার বাবা আমাকে বলতো, তুমি যদি বিশ্বাস করো এই কাজ তোমার করা উচিৎ, তুমি করো।"
রামকুমার মিশ্র বললেন, এই নির্যাতন যে পুলিশ একাই নিজেদের সিদ্ধান্তে করেছিল, তা নয়। এর পেছনে রাজ্য সরকারের নেতৃস্থানীয়দের সায় ছিল।
"মুখ্যমন্ত্রী, বিচার বিভাগ, পুলিশ সবারই এতে হাত ছিল, এবং তারা সবাই মিলে একে অপারেশন গঙ্গাজল নামকরণ করেছিল।"
চরম ক্ষুব্ধ ইন্দিরা গান্ধী
ভাগলপুরের এই ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর, ভারতের লোকসভায় তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে আবেগময় কণ্ঠে এক বক্তৃতা দেন যেখানে তিনি বলেন, এই ঘটনার কথা শুনে তিনি অসুস্থ বোধ করছেন।
তবে ভাগলপুরের সিংহভাগ মানুষের এ নিয়ে কোনো অনুতাপ ছিলনা। তাদের কথা ছিল- অপরাধীদের শিক্ষা হওয়া উচিৎ।
"আমি যখন বাজারে যেতাম। সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলতো দেখ দেখ এই সেই উকিল। এই লোকই এই শহরের সর্বনাশ করছে। পুলিশ অপরাধীদের অন্ধ করছে, কিন্তু এই উকিল সুপ্রিম কোর্টে নালিশ করেছে।"
"আমি যেন একঘরে হয়ে পড়েছিলাম। একমাত্র আমার বাবা ছাড়া আমার পাশে কেউই ছিল না।"
তদন্তের পর ১৫ জন পুলিশের সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদেরকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
আদালত নির্দেশ দেয় অন্ধ করে দেওয়া লোকগুলোর প্রত্যেককে ৫০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রতি মাসে সাড়ে সাতশ রুপি করে পেনশন দিতে হবে।
কিন্তু তারপর কী বিহারে এ ধরনের পাশবিক নির্যাতন বন্ধ হয়েছিল?
"তারপরও অপরাধীদের অন্ধ করে দেওয়ার চল পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখনও এটা চলছে," বিবিসিকে বলছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা অমিতাভ প্রসার।
২০১৭ সালে তিনি ভাগলপুরের বিষয়টি নিয়ে 'আইজ অব ডার্কনেস' নামে একটি তথ্যচিত্র বানান। জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে সেটি।
"এত বছর পরও ঐ ঘটনা আমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। ঐ যে দৃশ্য আমি কিশোর বয়সে দেখেছিলাম তা এখনও আমাকে তাড়া করে।"
ঐ পাশবিকতার শিকার হয়েছিলেন যে ৩৩ জন, তাদের ১৮ জন দারিদ্রে ভুগে মারা গেছেন। বাকিরা টিকে থাকার জন্য প্রাণপণে লড়াই করছেন। তাদের একমাত্র সম্বল মাসে সাড়ে সাতশ রুপির পেনশন।