ইতিহাসের সাক্ষী: দালাই লামা কীভাবে চীন থেকে ভারতে পালিয়েছিলেন
তিব্বতে চীনা অভিযানের মুখে ১৯৫৯ সালে জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে পালিয়েছিলেন তিব্বতী বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা। সেই নাটকীয় ঘটনার খবর বিশ্বকে জানিয়েছিলেন যারা - সেই সাংবাদিকদের দু'জন এবং দালাই লামার এক ভাইয়ের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির লুইস হিদালগো - যা নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব।
মার্চ মাস, ১৯৫৯ সাল। লাসায় চীনা সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে পাঁচ দিন ধরে পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে দালাই লামা অবশেষে ভারতে পৌছেছেন। খুব দ্রুতই সারা বিশ্বে এ খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।
এর আগে পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমের খবর থেকে তিব্বতের বাইরের লোকেরা জেনেছিলেন যে তিব্বতের রাজধানী লাসায় একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা দমন করেছে চীনারা। তবে দালাই লামা কোথায় আছেন - তা জানা যাচ্ছে না।
চীনা সৈন্যরা তার খোঁজে পার্বত্য এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল।
আর হিমালয়ের অপর পাশে ভারতে সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছিলেন একটা খবরের জন্য।
দালাই লামা যে ভারতে চলে গেছেন, সেই খবরটা প্রথম দিয়েছিল রয়টার্স বার্তা সংস্থা। দিল্লিতে রয়টার্সের সংবাদদাতা ছিলেন পিটার জ্যাকসন।
"আমি একটা প্লেন ভাড়া করে তেজপুর গিয়েছিলাম। সেটা দিল্লি থেকে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে," - বলছিলেন পিটার জ্যাকসন - "আমি সেখানে পৌঁছানোর পরপরই খবর পেলাম যে দালাই লামা পায়ে হেঁটে পার্বত্য পথ ধরে নেমে আসছেন। তিনি যখন এসে পৌঁছলেন এবং আমাদের দেখতে পেলেন, তখন তিনি দু'হাত তুললেন এবং সবার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এটা ছিল খুবই আবেগময় এক দৃশ্য।"
বিবিসি বাংলায় সম্পর্কিত খবর:
দালাইলামার ব্যক্তিগত জীবন আসলে কেমন?
ভারতের 'গোপন' সেনাবাহিনীতে কাজ করেন যেসব তিব্বতী
যে ব্যক্তিকে ছয় বছর বয়স থেকে আটকে রেখেছে চীন
ইতিহাসের সাক্ষী: কীভাবে তিব্বত দখল করেছিল চীনা বাহিনী
তিব্বতী পোশাক পরা কিশোর দালাই লামার আগমন প্রত্যক্ষ করতে সেখানে অপেক্ষা করছিল সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারের দল। ক্যামেরাম্যানদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রেম প্রকাশ।
"আমি ছিলাম ক্যামেরার পেছনে, চোখ ছিল ভিউফাইন্ডারে। আমার চোখে এখনো ভাসছে সেই দৃশ্য। দালাই লামার মধ্যে আমি যেন এক স্বর্গীয় প্রভা দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনি ছিলেন খুবই শান্ত, এবং তার হাসিমাখা মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল - একজন জনগণের নেতার জন্ম হচ্ছে।"
দালাই লামার বয়স যখন দুই বছর - তখন থেকেই তাকে দেখা হয় তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতার একজন অবতার হিসেবে। মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন তার জনগণের রাজনৈতিক নেতা।
ভারতে আসার সেই দিনটিতে তার সাথে ছিলেন তার মা, তার বড় বোন এবং ছোট ভাই তেনজিন চোগিয়াল।
তেনজিন চোগিয়ালকেও তিব্বতের আধ্যাত্মিক গুরুর একজন অবতার বলে মনে করা হয়। তিনিও তার ভাইয়ের মতই তিব্বতী আশ্রমে শিক্ষা গ্রহণ করেন। যখন তাকে সেই আশ্রম ছেড়ে আসতে হলো - তখন তার বয়স ১৩।
তার এখনো মনে আছে তাদের কীভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
"সেই অভ্যর্থনা ছিল এত আন্তরিক, এবং উষ্ণ যে তা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছিল। দার্জিলিং এবং কালিম্পং-এর মত অন্যত্র যে তিব্বতী সম্প্রদায় বাস করে - তারাও এসেছিল। অনেকে আনন্দে কাঁদছিল। ব্যাপারটা ছিল খুবই আবেগপূর্ণ।"
তেনজিন চোগিয়াল বলছিলেন, ভারতে আসার পর তার পরিবার নিজেদের নিরাপদ বোধ করেছিল।
"মনে হয়েছিল যেন আমরা মানসিক ভাবে একটা আবদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, যেন আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে পাচ্ছি, কোন ভয়ডর আর নেই। এটা ছিল দারুণ স্বস্তিদায়ক ব্যাপার।"
"আমার মা ও বোন তারা যখন লোকজনের সাথে কথা বলছেন সেটা ছিল একেবারেই অন্যরকম অনুভূতি। আমরা মন খুলে যা চাই তাই বলতে পারছি। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন খুবই অস্বস্তিকর একটা পোশাক গা থেকে খুলে ফেলেছি।"
চীন তিব্বতে সেনা পাঠায় ১৯৫০ সালে। তিব্বতীয়রা অনিচ্ছাসত্বেও চীনের কাছে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করে। আর এর বিনিময়ে দালাই লামার সরকারকে মোটামুটি আগের মতই তিব্বত পরিচালনা করতে দেয়া হয়।
কিন্তু ১৯৫৯ সালে চীন যখন সেখানে ভূমি সংস্কার শুরু করতে যায়, তখনই সেখানে উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করে। মার্চ মাসে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় সংঘাতপূর্ণ।
চীনারা লাসার ঠিক বাইরে একটি ব্যারাকে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দালাই লামাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু তারা বলেছিল, দালাই লামা যেন সাথে করে কোন সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে না আসেন।
তিব্বতীরা আশংকা করছিল যে চীন হয়তো দালাই লামাকে অপহরণ করার চেষ্টা করছে।
তিন লক্ষ তিব্বতী দালাই লামার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ঘেরাও করলো। কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল অভ্যুত্থান।
সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, দালাই লামা ও তার পরিবারকে অবশ্যই দেশ ছেড়ে যেতে হবে।
"আমার মা, আমার বোন, আমি নিজে, এবং আমাদের কিছু সাহায্যকারী, - আমরা লাসা ছাড়লাম, দালাই লামার যাত্রার আধঘন্টা আগে। সেই একই রাতে। আমার মা বললেন আমাদের লেই জনগোষ্ঠীর পোশাক পরতে।"
"তার পর আমি যখন আবার সেই ঘরে ঢুকলাম, দেখলাম মা আর আমার বোন দুজনেই পুরুষের পোশাক পরে আছেন। আমি হাসি ঠেকাতে পারছিলাম না। তারা যাতে কারো চোখে না পড়েন - সে জন্যই ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন।"
তারা যখন রওনা দিলেন তখন ধুলিঝড় হচ্ছিল। তার মধ্যেই তারা যাত্রার প্রস্তুতি নিলেন।
"দেহরক্ষীদের রেজিমেন্ট থেকে জনা তিনেক তিব্বতী সৈন্য এসে আমাদের বললো - যাবার সময় হয়েছে। তখন আমরা পশ্চিম দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে যে নদীটা আছে সেই দিকে গেলাম।"
তেনজিন চোগিয়াল তখন ছিলেন একটি অল্পবয়েসী ছেলে - তাই তার জন্য ব্যাপারটা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। তারা নদী পার হলেন ছোট ছোট নৌকায় করে।
নদীর ওপারে পৌঁছানোর পর তাদের চা খেতে দেয়া হলো। কয়েক ঘন্টা না খেয়ে থাকার পর সেই চা তার কাছে মনে হয়েছিল অতি মধুর।
"কেউ একজন আমাকে মাখন দেয়া চা খেতে দিল। আমার মনে হলো এত উপাদেয় চা যেন আমি কোন দিন খাইনি।"
অন্যদিকে দালাই লামাও সেই রাতে লেই জনগোষ্ঠীর লোকদের মত পোশাক পরে যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।
তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হলো একটি রাইফেল। তার সাথে ছিল আরো কয়েকজন কর্মকর্তার একটি ছোট দল। তাদের মধ্যে তাকে আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল না।
শহর থেকে বেরিয়ে তারা দালাই লামার পরিবারের অন্যদের সাথে যোগ দিলেন। তেনজিন চোগিয়ালের কাছে দালাই লামা ছিলেন একদিকে প্রিয় বড় ভাই, অন্যদিকে তিব্বতের "পবিত্র নেতা"।
"নদী পার হবার পর আমরা অপেক্ষা করছিলাম কখন ঘোড়া আসবে। যাতে বাকি পথটা আমরা ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারি।"
"আমি দালাই লামাকে সেই রাতে আর দেখিনি। পরের পুরো দিনটাও দেখিনি। সন্ধ্যায় যখন আমরা একটা ছোট গ্রামে এক আশ্রমে তাঁবু ফেললাম, তখন আমি তাকে আবার দেখতে পেলাম।"
এর পরের দু'সপ্তাহ ধরে ছোট এই দলটি কখনো ঘোড়ায় চড়ে, কখনো পায়ে হেঁটে রুক্ষ সমভূমি আর পার্বত্য পথ পাড়ি দিল।
"জায়গাটা অনেকটা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের মত। -প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রায় একই রকম। আমরা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলাম, আবার পথের যে অংশগুলো বেশি খাড়া - সেখানে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম।"
"এখানে লোকজন খুব কম। কখনো কখনো আমরা ছোট ছোট বৌদ্ধ আশ্রমে থামছিলাম। ভারত সীমান্তের কাছাকাছি আসার পর তুষারপাত হচ্ছিল। সেখানে আমরা কয়েকটি পর্বত পার হলাম - যেগুলো ২২ হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু।
তিব্বতের দক্ষিণাঞ্চল ছিল বিদ্রোহীদের দখলে। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল - এখানেই একটা নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলা হবে, সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করার কথা ছিল না।
"দালাই লামা এবং তার সাথের লোকদের ইচ্ছা ছিল, দক্ষিণ তিব্বতেই থাকা হবে, এবং তার পর চীনের সাথে একটা আলোচনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু যখন তারা সামরিক পদক্ষেপ নেয়া শুরু করলো, সেটাই ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুহূর্ত।"
"দালাই লামা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, ভারতে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার।"
লাসায় কি হচ্ছে - তার খবর দালাই লামা এবং তার দলের কাছে সব সময়ই আসছিল। সেখানে তিন দিন ধরে চীনা বাহিনীর সাথে তিব্বতীদের যুদ্ধ হয়েছিল, মারা গিয়েছিল কয়েক হাজার লোক।
দালাই লামার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। শহর ছেড়ে পালাতে থাকা লোকেরা জানায়, চীনা সৈন্যরা রাস্তার ওপরই মৃতদেহ পোড়াচ্ছিল।
"লাসা এবং অন্যান্য শহরে সহিংসতার তিন দিন পর, সেখান থেকে যুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা লোকেরা আমাদের সাথে যোগ দেয় - দালাই লামা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢোকার ঠিক আগে।"
"তাদের একজন ছিলেন দালাই লামার প্রাইভেট সেক্রেটারি। আমার মনে আছে, তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন - কারণ তার পায়ে গুলি লেগেছিল।"
মার্চ মাসের ৩১ তারিখ সারা পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পড়লো যে দালাই লামা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছেন।
তাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হয়, এবং তারা উত্তর ভারতের ধরমশালাতে তাদের আবাস গড়ে তোলেন। তার সাথে যোগ দেয় প্রায় ৮০ হাজার তিব্বতী। তারাও ওই এলাকাতেই থাকতে শুরু করে।
জায়গাটার নাম হয়ে যায় 'লিটল লাসা', আর সেটাই হয়ে ওঠে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের কেন্দ্র। তেনজিন চোগিয়াল এখনও সেখানেই থাকেন।