For Quick Alerts
ALLOW NOTIFICATIONS  
For Daily Alerts
Oneindia App Download

কালো বা ফর্সা: বাংলাদেশে সৌন্দর্যের নির্ধারক কেন গায়ের রং?

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাধারণত 'সুন্দর' বলতে 'ফর্সা' মানুষকে বোঝেন। কিন্তু সৌন্দর্যের সঙ্গে গায়ের রংয়ের সম্পর্ক কেন খোঁজা হয়?

  • By Bbc Bengali

কালো মেয়ে
BBC
কালো মেয়ে

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাধারণত 'সুন্দর' বলতে 'ফর্সা' মানুষকে বোঝেন। কিন্তু গায়ের রং কালো হলে কি মানুষ, বিশেষ করে নারীকে সুন্দর ভাবা হয় না?

সৌন্দর্যের সঙ্গে গায়ের রংয়ের সম্পর্ক কেন খোঁজা হয়?

কালো বলে তুলনা, নেতিবাচক মন্তব্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিহা বারীর ত্বকের রংটা এমন যেটাকে বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থে লোকে কালো বলে থাকেন।

নাজিহা বলছিলেন, তার পিঠাপিঠি বোনটির গায়ের রং উজ্জ্বল, যে কারণে তাকে একেবারে ছোটবেলা থেকেই নানারকম তুলনা শুনতে হয়েছে

তিনি বলেন, "আমাদের বাড়িতে যেসব আত্মীয়ারা আসতেন তারা একদম ছোট থেকেই আমার পরের বোনের সঙ্গে আমার তুলনা করে কথা বলতেন। বলতেন যে তুমি তো ওর মত সুন্দর হও নাই, আবার কেউ এমনও বলেছে যে তোমার যখন বিয়ে হবে, এসে তো ওকে (ছোট বোনকে) নিয়ে যাবে।"

"আবার একদম অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত মানুষেরাও হয়ত এক-দুই কথার পর বলছে যে অমুক সাবান দিয়ে গোসল কইরো, বা অমুক ক্রিমটা মাইখো!"

নাজিহা বলছেন, ছোটবেলাতে বিষয়টা তাকে পীড়া দিত।

আরো পড়তে পারেন:

রং ফর্সা করার মূল্য কীভাবে দিচ্ছেন লাখ লাখ নারী

নাম পাল্টাবে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে কি?

রং ফর্সাকারী ক্রিম কি আসলেই ফর্সা করে?

রং ফর্সা করা ক্রিম বেশ জনপ্রিয়
Getty Images
রং ফর্সা করা ক্রিম বেশ জনপ্রিয়

কিন্তু তিনি দেখেছেন, কেবল তার সঙ্গেই এমনটা ঘটেছে তা নয়, তার চেনা আরো অনেকের সাথেই এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছেন বা শুনেছেন তিনি।

তাকে যখন কেউ কমপ্লিমেন্ট দেন সেটাও হয় এমন যে 'তুমি দেখতে মিষ্টি, শুধু গায়ের রংটা চাপা'।

সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাধারণত গায়ের রংকেই সৌন্দর্যের ধারণার মূল নির্ধারক বিষয় বলে ধরে নেয়া হয়।

দেখা যায় অনেক সময়ই কোন একজন মানুষকে বর্ণনা করতে গিয়ে তার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়, ওই যে 'সুন্দর মত' অমুক---যার মানে হচ্ছে, ওই ব্যক্তির গায়ের রং ফর্সা। আর এই এ ধারণার শহর-গ্রাম ভেদ নেই, সবখানে একই অবস্থা।

সমাজে এমন ধারণা নতুন নয়।

কিন্তু সম্প্রতি বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে যখন দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো তাদের একটি সাপ্তাহিক আয়োজনে 'কালো, তবু সুন্দর' শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশ করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ফেসবুকের বাইরেও বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে---বলছিলেন কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

"কালো মানে সুন্দর না আর ফর্সা হলেই সুন্দর এমন ধারণার এখনো কী দরকার, সেটাই আমার মাথায় আসে না।"

একজন নারী ফেসিয়াল করাচ্ছেন।
AFP
একজন নারী ফেসিয়াল করাচ্ছেন।

"সুন্দর তো গায়ের রং দিয়ে জাজ করাই উচিত না, কিন্তু সেটাই এখনো হচ্ছে সমাজে।"

"আমরা তো ছোটবেলা থেকেই এমন ধারণা দেখছি, বাসায়ও দেখেছি, আবার টেলিভিশন বা সিনেমাতেও দেখেছি।"

"হুমায়ূন আহমেদ খুবই জনপ্রিয় লেখক আমাদের মধ্যে, তার কোন বইয়ের নায়িকা কালো দেখি নাই আমরা।"

অর্থাৎ গায়ের রং উজ্জ্বল হওয়া মানেই একজনকে সুন্দর বলে ধরে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিচার একই, মানে গায়ের রং বাদামী বা কালো হলে নারীর মত একজন পুরুষকেও অসুন্দর বা কম সুন্দর ধরে নেয়া হয়।

কিন্তু সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থানের কারণে তাকে বেশি সামাজিক ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়।

সৌন্দর্যের সংজ্ঞা

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মিশ্র জাতিগোষ্ঠী হবার কারণে এ অঞ্চলের মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য সকলের একই রকম নয়। গায়ের রং এবং উচ্চতার বিচারে যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি অমিল আছে চোখ ও নাকের আকৃতিতেও।

আর দ্রাবিড় শংকর জাতি হওয়ার কারণে, এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের গায়ের রং বাদামী বা গাঢ় কালো।

প্রথমত সেজন্যই যাদের গায়ের রং উজ্জ্বল মানে যারা দেখতে ফর্সা, তারা শতশত বছর ধরেই সমাজে কদর পেয়ে আসছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলছিলেন, গায়ের রংয়ের এই কদর ঔপনিবেশিক সময়ে বহুগুণ বেড়ে যায়, ওই সময়ই সৌন্দর্যের সংজ্ঞার সঙ্গে গায়ের রংয়ের সম্পর্কটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে,

"এই যে সুন্দর মানে গায়ের রং সাদা বা ফর্সা হতে হবে, এই ধারণা মূলত এসেছে আমাদের কলোনিয়াল লিগেসি থেকে। কারণ ভিক্টোরিয়ান সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা তাতে গায়ের রং খুব গুরুত্বপূর্ণ। গায়ের রং সাদা হবে, নাক চোখা হতে হবে। চোখ নীল হলে আভিজাত্য আরো বাড়ে। এবং সৌন্দর্যের ধারণার ক্ষেত্রে আমরা কখনো কলোনিয়াল লিগেসি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করিনি, বরং সেটা ক্রমে আরো বিস্তৃত হয়েছে।"

অধ্যাপক নাসরিন বলছেন, ক্রমে গায়ের রংয়ের উজ্জ্বলতাকে সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা ও সৌন্দর্যের সমার্থক ভাবা হয়েছে।

আর এই মানসিকতা এখন সমাজের সব স্তরে বিরাজমান। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিয়ে-শাদীর বিজ্ঞাপন দেখতে গেলে।

দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে অন্যান্য যোগ্যতার সাথে প্রাথমিক চাহিদা থাকে, 'সুন্দরী, ফর্সা' পাত্রী চাই।

ঢাকার প্রথম সারির একটি ঘটকালি প্রতিষ্ঠান, সানাই ম্যারেজ মিডিয়ার প্রধান সৈয়দ জুলফিকার হোসেন বলছিলেন, শতকরা ৯০ শতাংশ পাত্র পক্ষ এসে বলে ফর্সা মেয়ে চাই।

তিনি বলেন, " ৯০ শতাংশ লোকই এসে বলে গায়ের রং ফর্সা লাগবে। চাহিদামত কত শতাংশ সেটা পায়, তা অন্য আলাপ, কিন্তু সবাই এটাই চান প্রথমে। যেমন বিয়ের বাজারে এখন বিসিএস পাত্রের ডিমান্ড বেশি, তার পরিবার এসে বিসিএস পাত্রী খোঁজে না, খোঁজে সুন্দরী পাত্রী মানে যার গায়ের রং ফর্সা হতে হবে। হয়ত বললাম, ভাই একটা শ্যামলা ভালো মেয়ে আছে, কিন্তু তারা বলবেন যে ভাই সুন্দরী কি মেয়ে আছে, সেটা দেখান আগে।"

রিপোর্টারের প্রশ্ন: কিন্তু তার কারণ কী?

মি. হোসেন বলেন, "কারণ সবাই ভাবে বৌ ফর্সা হলে পরের প্রজন্ম মানে ছেলেমেয়ে হয়ত সুন্দর হবে, ফর্সা হবে, নিদেন পক্ষে কালো হবে না।"

ফেয়ারনেস ক্রিম আর রং ফর্সা করার ত্বকচর্চা

সমাজে এ রকম চাহিদা আর কদরের কারণেই, দেখা গেছে বিশেষ করে অল্প বয়েস থেকেই মেয়েদের মধ্যে ত্বকের রং উজ্জ্বল করার বা ফর্সা করার এক রকম প্রবল আগ্রহ থাকে।

দেখা গেছে দেশে ফেয়ারনেস ক্রিমের এক বিশাল বাজার রয়েছে। সেই সঙ্গে বিউটি স্যালন বা পার্লারগুলোতে ত্বকচর্চার যেসব সেবা দেয়া হয়, তার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রং ফর্সা করা, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানো, এবং রোদে পোড়া দাগসহ নানা রকম দাগ তোলার সেবা।

ঢাকার বনানীর একটি পার্লারের প্রধান নাহিদা হোসেন জানিয়েছেন, সেবা নিতে আসা নারীদের একটি বড় অংশ আসেন ত্বকের রং উজ্জ্বল করা সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা নিতে।

তিনি বলছিলেন, অনেক সময় দেখা যায় এমনকি ফর্সা মহিলারাও চান যেনে রং আরেকটু ফর্সা করা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন
BBC
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন

"খুব ফর্সা যারা তারাও ফর্সা হতে আসে আমাদের কাছে। যারা স্কিন ব্রাইটেনিং সেবা নেয়, বা রং ফর্সা করতে চায়, তাদের মধ্যে টিনএজ মেয়েরা যেমন আছে, মধ্যবয়েসিরাও আছে। বিয়ের আগে এক রকম তাগিদ থাকে মেয়েদের, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিবাহিত মেয়েরাও গায়ের রং ফর্সা করতে চায়।"

"পরিবারের এক ধরনের চাপ থাকে মনে হয় অনেকেরই, কারণ অনেকে এসে বলে অমুক ভাবীর চেয়ে আমার রং উজ্জ্বল করতে হবে।"

শহর এলাকাগুলোতে ত্বকচর্চার এসব সেবা নিতে আসা নারীর সংখ্যা কত এবং এ বাবদ গড়ে মাসে কত টাকা খরচ হয়, সে নিয়ে কোন জরিপ তা তথ্য নেই। যদিও এ ধরণের সেবা মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

কিন্তু পার্লারের এই সেবা সবার কাছে না পৌঁছালেও ফেয়ারনেস ক্রিম পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। বাংলাদেশে বহুজাতিক ও দেশি কোম্পানি মিলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ফেয়ারনেস ক্রিম বিক্রি করে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রং ফর্সা করার জন্য সব বয়েসী মানুষের মনে যে আকাঙ্ক্ষা, তা তৈরির পেছনে রয়েছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। যেমন ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন-চিত্রের কথা বাদ দিলে কোন বিজ্ঞাপনেই কালো নারীকে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় না।

বিজ্ঞাপন-চিত্রে নারীর এই অবয়ব চিত্রায়নের কারণ কী? বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক ইএক্সপির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরেশ যাকের বলছেন, "আমাদের প্রচলিত যে ধ্যান ধারণা, যে রুচি তার ওপর ভিত্তি করেই একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট হয়ে গেছে। আলাদা করে সেটা আরোপ করা হয়নি। এই স্ট্যান্ডার্ড তো আবার বহু যুগের চর্চা থেকে সেট হয়েছে। আর সমাজ হিসেবে আমাদের তো একটা বায়াস বা পক্ষপাত আছে ফেয়ারনেসের প্রতি। সাংস্কৃতিকভাবেও তার প্রতিফলন দেখা যাবেই, সেটা বিজ্ঞাপনচিত্র বলেন আর নাটক সিনেমা বলেন।"

চাই মানসিকতা পরিবর্তন

যুগ যুগ ধরে যে চর্চা হয়ে আসছে তার বদলাতে মানসিকতা পরিবর্তন দরকার সবার আগে, বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা।

তিনি বলেন, সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণার কারণে সামগ্রিকভাবে মেয়েদের মধ্যে হীণমন্ম্যতা তৈরি হয়। ফলে সেইটি আর সমাজের একটি বহুল প্রচলিত ধারণা বদলানোর জন্য যে ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন, সেখানে সমাজের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি

"পুরো বিষয়টির পেছনে রয়েছে একটি ধারণা যে নারী কেবল একটি শরীর, এই চিন্তার বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারা। কেবল শরীর হিসেবে দেখার কারণেই কালো ফর্সার বিষয়টি সামনে আসে, যখন একজন নারীকে মূল্যায়ন করা হয়। একজন ছেলেও কালো হতে পারে, কিন্তু তার ক্ষেত্রে বলা হয় 'হীরার আঙটি বাঁকাও ভালো'।"

"এজন্য আমার সাধারণভাবে বলি মানসিকতা বদলাতে হবে। কিন্তু সেটা বদলাবে কিভাবে? এজন্য গণমাধ্যমে ফেয়ারনেস ক্রিমরে প্রচার বন্ধ করতে হবে। একই সাথে পাঠ্যপুস্তুকে কালো-ফর্সা বিভেদের বিষয়ে সচেতন করার জন্য সরকারকে চেষ্টা চালাতে।"

সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণার যে শেকড় সমাজের গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা তুলে ফেলা অত সহজ কাজ নয়।

সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সাথে সাথে প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতার।

English summary
Black or fair: Why skin color is the determinant of beauty in Bangladesh?
চটজলদি খবরের আপডেট পান
Enable
x
Notification Settings X
Time Settings
Done
Clear Notification X
Do you want to clear all the notifications from your inbox?
Settings X