For Quick Alerts
ALLOW NOTIFICATIONS  
For Daily Alerts
Oneindia App Download

স্বাধীনতার ৫০ বছর: কলকাতা থেকে যেভাবে পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ লড়া হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে ঠিকই, কিন্তু কলকাতা ছিল এই যুদ্ধের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।

  • By Bbc Bengali

কলকাতায় একটি শরণার্থী ক্যাম্প
Getty Images
কলকাতায় একটি শরণার্থী ক্যাম্প

বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হত কলকাতা থেকে।

আবার তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের বহু বুদ্ধিজীবী, লেখক - শিল্পীরা যেমন ওই কমাস কলকাতাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।

যুদ্ধের সময়ে ভারতের সামরিক বাহিনী অথবা বিদেশ দপ্তরও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহরের মাধ্যমেই।

সেই প্রবাসী সরকারকে একটি ভবন দিয়েছিল ভারত সরকার।

৮ নম্বর থিয়েটার রোড, যার এখনকার নাম শেক্সপিয়ার সরণী, সেখানে বাড়িটি এখনও রয়েছে। তবে সেখানে নেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনও স্মৃতি, নেই কোনও নাম ফলকও।

ওই বাড়িটি আসলে ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর অরবিন্দ ঘোষ, যিনি পরবর্তীতে ঋষি অরবিন্দ, তারই মামা বাড়ি, সেখানেই জন্ম তার। এখন ওই ৮ নম্বর বাড়িটি অরবিন্দ ভবন।

.
BBC
.

একাত্তরের যুদ্ধের সময় শরণার্থী ক্যাম্পের জীবন কেমন ছিল?

পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে-সিনেমায় কেন মুক্তিযুদ্ধ উপেক্ষিত

পঁচিশে মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর যেভাবে এল স্বাধীনতার ঘোষণা

ছয় দফা ঘোষণা করে যেভাবে নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব


যুদ্ধের সময়ে নিয়মিত ওই বাড়িতে খবর সংগ্রহ করতে যেতেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত।

"বাড়িটার চারদিকে বি এস এফ পাহারা দিত, আর ভেতরে থাকত প্রবাসী সরকারের নিজস্ব প্রহরীরা। বাড়িটার ঠিক উল্টোদিকে নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেল। ওই হোটেলে পাকিস্তানের চর এসে ওঠে। ওপর থেকে বাড়িটির ছবি নিয়ে তা পাকিস্তানের সব খবরের কাগজে প্রকাশ করা হয়। বলা হয়েছিল কোথাও কোনও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না। কিছু মানুষ কলকাতার একটি বাড়িতে বসে ভারতের রক্ষীদের প্রহরায় এসব মিথ্যা রটাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নামে," বলছিলেন মি. দাশগুপ্ত।

তার কথায়, "এই ভবনেই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, সেনা প্রধান কর্ণেল ওসমানি, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলি - এরা বসতেন। তাজউদ্দিন আহমেদের পরিবার থাকত অন্য মন্ত্রীদের পরিবারের সঙ্গে ইন্টালি অঞ্চলে। কিন্তু মি. আহমেদ কোনও দিন সেখানে যাননি। ওই নয় মাস তিনি বোধহয় ঘুমোননি - এত পরিশ্রম করতেন। শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেব এই বাড়িতে বসতেন না। তার আলাদা একটি দপ্তর ছিল কাছেই।"

এই বাড়িতে আসার আগে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে মুজিবনগরে। তার আগের রাতে কলকাতা থেকে একেবারে গোপনে কয়েকজন সাংবাদিককে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

তাদের মধ্যেই ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বেতারকেন্দ্র আকাশবাণীর সংবাদ প্রযোজক উপেন তরফদার। সেসময়ে তিনি সংবাদ বিচিত্রা নামের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সাময়িক ঘটনার অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতেন।

মি. তরফদার কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু তার পুত্রবধূ দেবযানী আইচকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শুনিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কাহিনীগুলি। সেগুলো লিপিবদ্ধও হয়েছে একটি বইতে।

দিলীপ চক্রবর্তী
BBC
দিলীপ চক্রবর্তী

মিসেস আইচ বলছিলেন, "বাবাই [উপেন তরফদার] একটি ছোট্ট মেয়ের কথা খুব বলতেন। মেয়েটির নাম আয়েশা। সে নিজের বাড়ির সামনেই পরিবারের সবাইকে খুন হতে দেখেছিল। কোনওভাবে সে কচুরীপানার মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। পরের দিন কোনও একটা দলের সঙ্গে মিলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসে। বাবাই যখন তার সঙ্গে কথা বলছিল, সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। তার ওই চাহনি, ওই আর্তিটা বাবাইকে শেষ জীবন পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে করত।"

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে উপেন তরফদারের লেখা বই থেকে জানা যায় আয়েশা নামের ওই কিশোরীকে ভারতীয় বাহিনী উদ্ধার করে হাসপাতালেও ভর্তি করিয়েছিল, কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি।

তবে মি. তরফদার তার প্রযোজিত সংবাদ বিচিত্রা অনুষ্ঠানে আয়েশার কন্ঠ শুনিয়েছিলেন রেডিও শ্রোতাদের।

"ওই ঘটনাটা ছাড়া আরেকটা খুব গায়ে কাঁটা দেওয়া দিনের কথা বলতেন আমার শ্বশুরমশাই। তখনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। রাত প্রায় বারোটা বাজে। অফিস থেকে বেরনোর ঠিক আগেই বাবাইদের বলা হল আজ রাতে বাড়ি যাওয়া যাবে না! কিন্তু কেন, সেসবরে কোনও উত্তর কারও জানা নেই," বলছিলেন দেবযানী আইচ।

তার কথায়, "তাদের বলা হল কলকাতা প্রেস ক্লাবে চলে যেতে। ওই অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে হেঁটে তারা ময়দানে প্রেস ক্লাবে পৌঁছলেন। সেখানে দেখলেন আরও কয়েকজন সাংবাদিক হাজির। তারাও কেউ জানে না কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। অবশেষে একটা গাড়িতে চেপে তারা রওনা হলেন। অন্ধকার রাতে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চলার পরে যখন প্রায় ভোর হচ্ছে, সেই সময়ে তারা একটা বিরাট মাঠে পৌঁছলেন। প্রচুর মানুষ অস্ত্র হাতে সেখানে হাজির, বাংলাদেশের একটা পতাকা আছে। একটা মঞ্চ গড়া হয়েছে। জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছিল মুজিবনগর।"

সেদিনই মুজিবনগর সরকারের পত্তন হয়েছিল, যার সাক্ষী থেকে ছিলেন উপেন তরফদারের মতো হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক।

শিখা মুখার্জী
BBC
শিখা মুখার্জী

কলকাতায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার যখন যুদ্ধ পরিচালনা করছে, তখন রণাঙ্গণে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার অনেক সাংবাদিক। যুদ্ধক্ষেত্রের খবর বিশ্ববাসীকে জানাতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তাদের। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কদিন পরে মার্চের ২৯ তারিখ যশোরে পৌঁছিয়েছিলেন কালান্তর পত্রিকার তরুণ সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী। বলছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে তোলা তার প্রথম ছবিটার ইতিহাস।

"আমি যে গ্রামে পৌঁছলাম, সেটা যশোরের সীমান্তে হলেও আদতে খুলনা জেলার অংশ। দেখে তো বোঝার উপায় নেই যে গ্রামটা ভারতের না বাংলাদেশের। হঠাৎই দেখি গাছের আড়াল থেকে উদোম গায়ে একটা বাচ্চা ছেলে। সে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাতের দুই আঙ্গুল জড়ো করে বলল 'গুড়ুম, গুড়ুম'। তারপরেই খিল খিল করে হাসি। ছবি তুললাম বাচ্চাটির। সেটাই বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধ কভার করতে গিয়ে আমার তোলা প্রথম ছবি। ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, গুড়ুম গুড়ুম কেন করলে? সে বলল, গুড়ুম কইর‍্যা ইয়াহিয়ারে মারুম। আমারে একডা বন্দুক দিবা?" স্মৃতিচারণ করছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী।

বেশীরভাগ সাংবাদিকই কলকাতায় তাদের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, কিন্তু ইংরেজী দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকার দুই শিক্ষানবীশ সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরজিত ঘোষের সেই সৌভাগ্য হয়নি। কুমিল্লায় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং পরে তাদের হত্যা করা হয়।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহের কাজে যথেষ্ট ঝুঁকির কারণেই আকাশবাণীর রেডিও প্রযোজক উপেন তরফদারকে বন্ড সই করে যেতে হয়েছিল সেখানে। সময়টা এমনই ছিল যে তার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা।

কলকাতা থেকে বহু দূরে, দেশের রাজধানী দিল্লিতে যেসব বাঙালী সাংবাদিক কাজ করতেন, তারাও পরিবার পরিজন নিয়েই কীভাবে যুদ্ধে পরোক্ষভাবে মদত দিয়েছিলেন, সেই ঘটনা শোনাচ্ছিলেন সিনিয়ার সাংবাদিক শিখা মুখার্জী।

তার বাবা দিলীপ মুখার্জী সেই সময়ে ছিলেন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার দিল্লির বুর‍্যো চিফ। মি. মুখার্জীর পারিবারিক বন্ধু কে এম সাহাবুদ্দিন পাকিস্তান সরকারের প্রথম বাঙালী কূটনীতিক, যিনি নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে চাকরি ছেড়েছিলেন।

তখন স্কুল ছাত্রী শিখা মুখার্জীর কাজ ছিল গোপনে মি. সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে খবর এনে তার বাবার মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া।

"২৮ মার্চ আমি স্কুল থেকে সবে ফিরেছি। একটা টেলিফোন এল। লাইনের ওদিকে বুলু আপা। মিসেস বুলবুল সাহাবুদ্দিন। বললেন, তোমার বাবাকে এক্ষুনি টেলিফোন করে বাড়ি চলে আসতে বল। খুব জরুরি কথা আছে। আমি বাবার অফিসে এদিক ওদিক ফোন করে খবর দিলাম। বাবা ফিরে এলে সবাই আলোচনায় বসলেন। কথাবার্তা অবশ্য কয়েকদিন ধরেই হচ্ছিল যে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি অফিসারদের যদি পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে দেওয়া হয়, তাহলে তো ডিফেক্ট করতে হবে। সেদিন মি. সাহাবুদ্দিন বাবাকে বললেন যে বদলির অর্ডার এসে গেছে," বলছিলেন শিখা মুখার্জী।

মিজ মুখার্জীর বাবা ছিলেন পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ একজন সিনিয়ার সাংবাদিক। তাই ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগও তার যথেষ্ট ভাল ছিল।

দেবযানি আইচ
BBC
দেবযানি আইচ

মিজ মুখার্জী বলছিলেন, "সেই সময়ে বাংলাদেশ ডেস্ক দেখতেন যে যুগ্ম সচিব অশোক রায়, তিনিও এলেন আমাদের বাড়িতে। আলোচনা হল। আমি যেহেতু সব আলোচনাই শুনতাম সেখানেও ছিলাম। মি. সাহাবুদ্দিন এবং আরেকজন ডিফেক্ট তো করতে চান, কিন্তু সব ব্যবস্থা হবে কী করে! তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ কীভাবে রাখা হবে! তাদের ওপরে তো পাকিস্তান সরকারের নজর রয়েছে, টেলিফোনও নিশ্চই ট্যাপ হচ্ছে! তখন আমি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিলাম খবর আদান প্রদানের।"

পোষা কুকুরটিকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বেরতেন তখন স্কুল ছাত্রী শিখা মুখার্জী। তিনি যে এক পাকিস্তান দূতাবাসের এক বাঙালী কূটনীতিকের সঙ্গে ভারত সরকারের খবর আদান প্রদান করছেন, এই সন্দেহ কেউ করতে পারবে না। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন।

"এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চূড়ান্ত হল যে কবে ওরা ডিফেক্ট করবেন। ওরা দুজন একটা জায়গায় অপেক্ষা করলেন। ভারত সরকারের লোক এসে তাদের একটা সেফ হাউসে নিয়ে গেল। আবার প্রায় মাঝরাতে মি. সাহাবুদ্দিন আর অন্য অফিসার আমাদের বাড়িতে এলেন। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সামনে তারা ঘোষণা করলেন যে পাকিস্তানের কূটনীতিক আর নন তারা, স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনীতিক। পরে একটা দপ্তরও খুলেছিলেন তারা দিল্লিতে," বলছিলেন শিখা মুখার্জী।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেমন মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য রণাঙ্গনে গেছেন, তেমনই যুদ্ধের সময়ে যারা ভারতে চলে এসেছিলেন, তাদের জন্যও অবারিত দ্বার ছিল কলকাতার বহু বাড়িতে। স্বল্প পরিচিত, একেবারেই অপরিচতদেরও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যেত অনায়াসেই। সেরকমই একটি ঘটনার কথা বলছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী।

"আমাদের তখন বয়স কম। বন্ধুদের নিয়ে নিষিদ্ধ মাংস খেয়েছি একদিন। আমি তখন পার্ক সার্কাসে এক বন্ধুর বাড়িতে খুব যেতাম। সেই বাড়ির বৃদ্ধা ঠাকুমা গরুর মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা জানতে পেরে আমার আর তার নাতিকে বাড়িতে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমরাও তার ভাবনা চিন্তাকে আঘাত দিতে চাইনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খবর এল জনা চারেক মুক্তিযোদ্ধার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার ওই বন্ধু বলল দেখি আমার বাড়িতেই ব্যবস্থা করতে হবে," বলছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী।

পরের দিন সকালে মি. চক্রবর্তীর সেই বন্ধু এসে বলেছিলেন, "চল চল বাড়িতে মজা দেখবি।"

জিয়াদ আলী
BBC
জিয়াদ আলী

"ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখি ওর সেই ঠাকুমা, যিনি আমাদের গোমাংস খাওয়ার জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন, তিনি তার ঠাকুরঘরে ওই চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে থাকতে দিয়ে নিজে শুয়েছেন বারান্দায়। ঠাকুমাকে মজা করে বলেছিলাম, 'ও আমরা হিন্দু হয়ে গরুর মাংস খেয়েছি বলে বাড়িতে ঢুকতে দিলে না আর এরা তো সব নিরামিষ খায় তাই না?" মজা করে বলছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী।

বাংলাদেশ থেকে আসা নাম না জানা মানুষ যেমন আশ্রয় পেয়েছেন কলকাতার মানুষের কাছে, তেমনই ঢাকা থেকে যেসব লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা সাময়িক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন, তাদেরও থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে এই শহরেই। সেরকমই একদল লেখক শিল্পী প্রকৌশলী ঢাকা আর চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসে চালু করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেই ভবন এখন অবশ্য আর অবারিত দ্বার নয় - বাড়িটির বর্তমান মালিক কাউকে প্রবেশ করতে দেন না। কিন্তু ৭১ সালে সেটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কবি ও প্রাবন্ধিক জিয়াদ আলি বলছিলেন, "ওই বাড়িটা সংস্কৃতি কর্মীদের একটা মেলামেশার বড় জায়গা হয়ে উঠেছিল। দেখেছি অনেক সময়ে খবর লেখার জন্য সাদা কাগজও পেতেন না তারা। সংবাদপত্রের পাশে যে সাদা অংশটা, সেখানে খবর লিখে সম্প্রচার করতেন।"

"বেতার চালু হওয়ার কয়েক মাস পরে এলেন কামাল লোহানী। বার্তা সম্পাদক হয়ে যোগ দিলেন তিনি। একদিন কথায় কথায় আমার এক পাড়াতুতো দাদা কামাল আহমেদকে বললেন যে তারা সম্প্রচারের জন্য ভাল উদ্দীপক দেশাত্মবোধক গান পাচ্ছেন না। কামাল আহমেদ দা লোহানীভাইকে বললেন যে গোবিন্দ হালদার দাদা অনেক গান লিখেছেন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম নিয়ে। তার গানের খাতা আপনাকে দেব," বলছিলেন জিয়াদ আলি।

গোবিন্দ হালদারের ওই গানের খাতাতেই যেমন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে ছিল, তেমনই ছিল মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি বা এক সাগর রক্তের বিনিময়ের মতো কালজয়ী গান।

জিয়াদ আলি বলছিলেন মি. হালদার হয়তো বিখ্যাত গীতিকারদের পর্যায়ে পড়তেন না, কিন্তু তার গানে যে আবেগ, দেশপ্রেম ছিল, সেটাই রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করত।

সমর দাস ওই খাতায় লেখা কয়েকটি গানের সুর করলেন আর আপেল মাহমুদ গাইলেন।

গোবিন্দ হালদারের গানগুলোর মতোই আরেকটি গান মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণ উদ্বুদ্ধ করেছিল।

এরকমই আরেকটি গান ছিল 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠ...।'

প্রখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এক চায়ের দোকানের আড্ডায় বসে গানটি লিখে ফেলেছিলেন -- সঙ্গেই ছিলেন শিল্পী অংশুমান রায়। তিনি গানটিতে সুর বাঁধতেই আড্ডায় হাজির আরেক ব্যক্তিত্ব - উপেন তরফদার - গানটি রেকর্ড করে নেন।

তার সংবাদ বিচিত্রা অনুষ্ঠানে ৭ই মার্চের রেসকোর্সের ভাষণের একটা টেপ যখন মি. তরফদারের হাতে আসে বেশ কিছুদিন পরে, তার সঙ্গেই এই গানটি মিশিয়ে দিয়ে পরিবেশন করে ছিলেন বেতার প্রযোজক মি. তরফদার।

তার পুত্রবধূ দেবযানী আইচ বলছিলেন, "একটা সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানে গানের সঙ্গে একটা ভাষণ যে মিশিয়ে দিয়ে পরিবেশন করা যায়, সেটা তখন কেউ ভাবতেই পারেননি। প্রথমে সবাই বাবাইকে বারণ করেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ যখন অনুষ্ঠানটা সম্প্রচারিত হয়, তখন সকলেই উচ্ছসিত।"

মুক্তিযুদ্ধের যে এই বিরাট কর্মকান্ড চলছে, তাতে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের যে আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরের ভারতীয়রাও এই আবেগে শামিল হয়েছিলেন।

প্রবীণ সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তীর কথায়, "বাঙালীদের না হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু কেরালা, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশে, উড়িষ্যার মানুষের কীভাবে আবেগ এসেছিল? আমি তো এখানে যেসব বাংলাদেশের শিল্পীরা ছিলেন, তাদের নিয়ে ওইসব রাজ্যে গিয়েছিলাম! তারা ভাষা বোঝেন না। শুধু দুটো কথা জানেন তারা - জয় বাংলা আর বঙ্গবন্ধু। তাতেই টাকা পয়সা চাইলেই দিয়ে দিচ্ছেন, গয়না খুলে দিয়ে দিচ্ছেন। আসলে যেটা বলতে চাইছি, ভারতের মানুষের, ভারত সরকারের একটা ইম্প্লিসিট জায়গা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি। সেই জায়গা থেকে সবাই একযোগে এগিয়ে গিয়েছিলেন সহায়তা করতে।"

মি. চক্রবর্তী যেমন সাধারণ মানুষের আর্থিক সহায়তার কথা বলছিলেন, তা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারও মুক্তিযুদ্ধের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতেন - যদিও যুদ্ধ শুরুর মাস তিনেক পর থেকে রাজ্যে আর আলাদা সরকার ছিল না। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল এবং পশ্চিমঙ্গের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। যিনি পরের বছর পশ্চিবমঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ পান।

কিন্তু শুধু কি ওই আর্থিক সহায়তা দিয়েই কি অতগুলো মাস কলকাতায় থেকেছিলেন বাংলাদেশের মানুষ?

জিয়াদ আলি বলছিলেন, "যেসব লেখক শিল্পীরা ঢাকা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন, তাদের অনেকেই উচ্চ বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তারা একটা ভাল রকমের অর্থের সংস্থান সঙ্গে নিয়েই কলকাতা এসেছিলেন। তবে যারা একটু কম বয়সী, তারা একটু অন্যভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এসেছিলেন।"

'অন্যভাবে' অর্থ সংগ্রহটা কীরকম?

"বাংলাদেশে তখন তো গ্রামাঞ্চলেও ব্যাঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে। এরা ভারতে আসার পথে ওইসব ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ আদায় করে নিয়ে এসেছিলেন," বলছিলেন জিয়াদ আলি।

জানতে চেয়েছিলাম, ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ আদায় করার মানে কি ব্যাঙ্ক লুঠ?

"জানি না কথাটা বলা উচিত হবে কী না, তবে হ্যাঁ, সেটাই," বলছিলেন জিয়াদ আলি।

নয়মাসের যুদ্ধ যেদিন শেষ হল, সেদিন জিয়াদ আলি কলেজ স্ট্রীটের একটি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের উচ্ছাস আর দিলীপ চক্রবর্তী সেদিন তার খবরের কাগজের জন্য কোনও সংবাদ লিখতে পারেননি আবেগের বশে।

কলকাতা আর বাংলাদেশের কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন শহরের রাজপথে - বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপভোগ করতে।

তার দুদিন পরে, ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা ছেড়ে নিজেদের দেশের দিকে রওনা হয়েছিলেন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা।

কিন্তু কলকাতার আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তারা ভোলেননি।

যুদ্ধ শেষের পরে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব রহমান নিজেই পশ্চিমবঙ্গকে জানিয়েছিলেন কৃতজ্ঞতা।

"আমি যদি মিসেস গান্ধী, ভারতের জনসাধারন, ভারতের সামরিক বাহিনী, কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারন, আসামের জনসাধারণ, ত্রিপুরার জনসাধারন, মেঘালয়ের জনসাধারনকে মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। তাদের আমি আপনাদের পক্ষের থেকে, সাত কোটি দুখী বাঙালীর পক্ষের থেকে ধন্যবাদ জানাই। এক কোটি লোককে তারা আমার খাবার দিয়েছে," বলেছিলেন মুজিবর রহমান।

English summary
50 years of independence: The way the liberation war of Bangladesh was conducted from Kolkata
চটজলদি খবরের আপডেট পান
Enable
x
Notification Settings X
Time Settings
Done
Clear Notification X
Do you want to clear all the notifications from your inbox?
Settings X