দ্রৌপদীকে বিয়ে করতে তিন দিন গ্রামে হত্যে হয়ে পড়ে ছিলেন শ্যামচরণ, স্মৃতির সাগরে পাহাড়পুরের বাসিন্দারা
দ্রৌপদীকে বিয়ে করতে তিন দিন গ্রামে হত্যে হয়ে পড়ে ছিলেন শ্যামচরণ, স্মৃতির সাগরে পাহাড়পুরের বাসিন্দারা
দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি হলেন দ্রৌপদী মুর্মু। এই খবরের সঙ্গে সঙ্গে ওড়িশার আদিবাসীদের পাহাড়পুরে গ্রামের মধ্যেও যেন খুশির হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তাদের গ্রামের বধূ রাইসিনা হিলের বাসিন্দা হতে চলেছেন। গ্রামের তরুণ সম্প্রদায় যখন দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে গর্ব করতে ব্যস্ত। ঠিক সেই গ্রামের প্রবীণরা ডুব দিয়েছেন স্মৃতি মেদুরতায়। বিয়ে হয়ে দ্রৌপদী মুর্মুর পাহাড়পুর গ্রামে যেন এই তো কয়েক বছর আগে এলেন। গ্রামের প্রবীণদের চোখের সামনে এখনও যেন ভাসছে সব কিছু।
স্মৃতিমেদুরতায় ডুব পাহাড়পুর গ্রামের বাসিন্দাদের
ওড়িশার অজানা-অচেনা গ্রামের দিকে এখন ভারতের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের চোখ। এই গ্রামের বাসিন্দাই তো এখন ভারতের রাষ্ট্রপতি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পাহাড়পুর গ্রামে কখনও ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে তো কখনও রোদের আভাস। সেখানেই ছোট্ট বাঁশের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন লক্ষণ বাসি। সম্পর্কে তিনি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বামী শ্যামচরণের মামা। বয়সের ভারে কোমরটা একটু ঝুঁকে গিয়েছে। যুবককালের পেটাই চেহারা এখনও ধরা পড়ে লক্ষণ বাসির শরীরে। 'দ্রৌপদী মুর্মুকে চেনেন?' প্রশ্নের উত্তরে একেবারে স্মৃতির গভীরে ডুব দিলেন তিনি। 'আমরাই তো শ্যামচরণের সঙ্গে দ্রৌপদীর বাড়ি গিয়েছিলাম বিয়ের কথা বলতে।' হালকা হেসে তিনি বলতে শুরু করলেন, 'কত বছর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা। শ্যামচরণের সঙ্গে আমরা দ্রৌপদীর বাড়ি গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগের দিন শ্যামচরণ আমাকে বলল, প্রেমে পড়েছে। দ্রৌপদীকে সে ভালোবাসে। তার কিছুদিন পরে দ্রৌপদী টুডু হয়ে গেলেন দ্রৌপদী মুর্মু (তিনি বিয়ের আগে টুডু ছিলেন)। আর পাহাড়পুর গ্রাম হয়ে গেল তাঁর শ্বশুরবাড়ি।'
কলেজে পড়ার সময়ই শ্যমচরণের প্রেমে পড়েন দ্রৌপদী
প্রথম থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন দ্রৌপদী। তিনি সপ্তম শ্রেণি থেকেই গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে ভুবনেশ্বরে পড়তে যান। গ্রামের তিনি প্রথম মহিলা যিনি ভুবনেশ্বরে পড়তে গিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথমে আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর তিনি স্নাতকের জন্য ভুবনেশ্বরের রমা দেবী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময়ই শ্যামচরণ মুর্মুর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮০ সালে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে শ্যামচরণ দ্রৌপদীর বাড়ি পৌঁছয়।
দ্রৌপদীর বাবাকে মানাতে বেগ পেতে হয়েছিল শ্যামচরণকে
আজ যেন স্মৃতি রোমন্থনের দিন। বাড়ির মেয়ে রাষ্ট্রপতি বলে কথা। আজকে পুরনো কথা মনে করে ঠোঁটের কোনে হাসি আনবে না তো কবে আনবে। দ্রৌপদী মুর্মুর বাড়ির অবস্থাও সেই রকম। দ্রৌপদীর ভগ্নিপতি বলেন, 'আমার বিয়ের পর অনেক গল্প শুনেছি। শ্বশুরমশাই মোটেই রাজি ছিলেন না দ্রৌপদীর সঙ্গে শ্যামচরণের বিয়ে দেওয়ার বিষয়ে। আসলে তিনি ভালোবাসা করে বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। দ্রৌপদী ঠিক করে নিয়েছিলেন, শ্যামচরণ ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেন না। আর শ্বশুর মশাই সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যামচরণের সঙ্গে বিয়ে হলে তিনি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করবেন। এদিকে হবু শ্বশুরকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে দ্রৌপদীর গ্রামে শ্যামচরণ মামা লক্ষণ বাসি, কাকা ও কয়েকজন আত্মীয়কে নিয়ে তিন দিন বসেছিলেন।'
দ্রৌপদী মুর্মুর বিয়েতে যৌতুক ছিল একটি গোরু ও ষাঁড়
সাংবাদিকদের কাছে ভাইঝির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে দ্রৌপদীর পিসি যমুনা টুডু সাঁওতালি ভাষায় বলেন, একটি গোরু ও ষাঁড় এবং ১৬ জোড়া জামার বিনিময়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে শ্যামচরণের বিয়ে হয়ে যায়। দ্রৌপদী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের। অন্যদিকে শ্যামচরণও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাসিন্দা ছিলেন। আর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিয়েতে যৌতুক আদান-প্রদানের একটা রীতি রয়েছে।
বিয়ের তারিখ কেউ জানে না
শ্যামচরণের মামা লক্ষণ বাসি বলেন, ১৯৮০ সালে ওদের বিয়ে হয়েছিল মনে আছে। কিন্তু বিয়েতে মুরগীর মাংস হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের তারিখ মনে নেই। অন্যদিকে, হেসে দ্রৌপদী মুর্মুর পিসি বলেন, 'আজকের মতো দিন আসবে, আমাদেরকে এসব কথা বলতে হবে, তাই কি কোনওদিন ভেবেছিলাম? তাহলে তারিখটা মনে রাখতাম।' দ্রৌপদী মুর্মুর ভাই, পিসি, কিংবা মামার বাড়ির কোনও সদস্যের শ্যামচরণের সঙ্গে বিয়ের তারিখ মনে নেই।
পাহাড়পুর গ্রামে শ্যামচরণের ভিটে এখন আবাসিক স্কুল
পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করে, মান ভাঙিয়ে বিয়ে করলেও, দ্রৌপদী মুর্মুর পরবর্তী জীবন খুব কষ্টের। দ্রৌপদী মুর্মু কনের বেশে পাহাড়পুর গ্রামের যে বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলেন, তা বর্তমানে আবাসিক স্কুল। শ্যাম লক্ষণ শিপুন উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৮৪ সালে দ্রৌপদীর তিন বছরের কন্যা মারা যায়। ২০১০ সালে তাঁর বড় ছেলে, তার ঠিক তিন বছর বাদে ২০১৩ সালে তাঁর মেজ ছেলে এবং পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। তারপরে ২০১৬ সালে দ্রৌপদী মুর্মু তাঁর স্মৃতিতে ভরা বাড়িটিকে স্কুলে পরিণত করেন। প্রতি বছর পুত্র ও সন্তানদের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্কুলে আসেন। স্কুলের এক ছাত্রী বলেন, 'দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের রাষ্ট্রপতি। এটা আমাদের কাছে খুব গর্বের।'