জেনে নিন 'প্যাডম্যান' অরুণাচলমের লড়াইয়ের কাহিনি, মহিলা স্বাস্থ্য উন্নয়নে তাঁর অবদান যুগান্তকারী
সংস্কারের বাধা কাটিয়ে মহিলা স্বাস্থ্য সচেতনায় যুগান্তকারী সাফল্য এনেছেন দেশের 'প্যাডম্যান' অরুণাচলম।
স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছর পার হয়ে গেলেও সমাজ গঠনে মহিলা স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক থেকে দিক দিয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আজও পিছিয়ে ১২৫ কোটির দেশ ভারত। যার কারণ হল যুক্তি সঙ্গত ভাবধারার অভাব।
সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকা অপরিসীম। সমাজের উন্নয়নের অন্যতম কারিগর , মহিলাদের সুস্থ রাখতে , তাঁদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নও প্রয়োজন। যার প্রধান শর্ত হল, পরিচ্ছন্নতা। আর এই মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা তথা স্বাস্থ্য-পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত ভাবনা থেকেই দেশের গরীব মহিলাদের জন্য সবচেয়ে কম দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুত করে তাক লাগিয়ে দেন তামিলনাড়ুর অরুণাচলম মুরুগানান্থম। মহিলা স্বাস্থ্য সচেতনতায় সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আজ গোটা দেশের গর্ব তিনি। স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাবর উদ্যোগে তাঁর এই যুগান্তকারী ভাবনা চিন্তায় এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা মোটেও সহজ ছিল না। কেমন ছিল সেই পথ চলা দেখে নেওয়া যাক।
'প্যাডম্যান' অরুণাচলম মুরুগানান্থম
কম দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড বানিয়ে ভারতের দরিদ্র মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতন করার যে আন্দোলন অরুণাচলম শুরু করেন, তা নিঃসন্দেহে অনবদ্য। ব্র্যান্ডেড কম্পানির প্যাড তৈরিতে যে দাম লাগে , তার এক তৃতীয়াংশ দামেই স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড বিক্রি করে থাকে অরুণাচলমের সংস্থা। মহিলাদের ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহার্য এই ন্যাপকিনগুলি পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সাহায্য় করে, যাতে মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার একটি বড় দিক।
কে এই অরুণাচলম ?
১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে হঠাখই দিশেহারা বোধ করে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের ছোট্ট অরুণাচলম। সংসারে অর্থাভাবে পড়াশুনা আর বেশিদিন চালাতে পারেনি সে। রোজগারের জন্য মাকে সাহায্য করতে হত কিশোর অরুণাচলমকে। দোকানে বাজারে খাবার সাপ্লাইয়ের কাজ করতে সে। পরে কখনও শ্রমিকের কাজ, বা টুল সাপ্লায়ারের কাজও করতে থাকে সে। তবে এইসব বহুবিধা কাজের মধ্যেই আশপাশের নানা জিনিস নিয়ে বড় কৌতূহল ছিল কিশোর অরুণাচলমের।
অরুণাচলমের পথ চলার কাহিনি
এরপর ১৯৯৮ সালে বিয়ে করেন অরুণালচলম। স্ত্রী শান্তির সঙ্গে সুখের সংসার শুরু হয়। তখনই একদিন অরুণাচলম লক্ষ্য করেন যে, শান্তি তাঁর কাছ থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছেন। পরে তিনি দেখেন যে বাড়ির ধুলো পরা, ফেলে দেওয়া কাপড় তাঁর কাছ থেকে লুকোচ্ছেন শান্তি। এই কাপড় ঋতুস্রাবের সময়ে ব্যবহার করতেন শান্তি। কারণ দামি স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা সম্ভব ছিল না শান্তির মতো গরীব ঘরের স্ত্রীর পক্ষে। এই ঘটনা থেকেই কম দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানোর চিন্তা মাথায় আসে অরুণাচলমের। যাতে শান্তির মতো অনেক গরীব ঘরের মেয়ে তা কেনার ক্ষমতা রাখেন।
শুরু হয় কঠিন সফর
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অরুণাচলম বানাতে শুরু করেন সুতির স্যানিটারি প্যাড। যার নিরীক্ষা তিনি তাঁর স্ত্রী ও বোনের ওপর করতে শুরু করেন। দেখা যায়, সেই ন্যাপকিন খুব একটা কার্যকরি নয়। আবারও চেষ্টা শুরু করেন অরুণাচলম। লেগে থাকেন নিজের উদ্যোগে।
অরুণাচলমের একার লড়াই
অরুণাচলমের প্যাড তৈরির কথা জানতে পেরে তাঁকে তাঁর মা ও স্ত্রী ভর্ৎসনা করেন। একঘরে হতে থাকেন অরুণাচলম। সারা গ্রাম মনে করতে থাকে অরুণাচলম পাগল হয়ে গিয়েছেন। এই ধরণের জিনিস কেউ তৈরির কথা ভাবতেও পারে, এটাই গ্রামবাসীর ধারণার অতীত হয়ে ওঠে। সমাজ থেকে এক প্রকার বহিষ্কৃত হয়ে যান তিনি।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সাফল্য
একের পর এক ধাক্কা খেয়ে শেষ ২০০৬ সালে প্রথমবার স্যানিটারি প্যাড তৈরির মেশিন নির্মাণ করতে সক্ষম হন অরুণাচলম মুরুগানান্থম। জয়শ্রী ইন্ডাস্ট্রিজ নামের আওতায় শুরু করেন তাঁর সংস্থার যাত্রা। যে সংস্থায় চাকরিতে যোগ দেন বহু মহিলা কর্মী। কর্মসংস্থান হয় গ্রামের মহিলাদের।
ব্যবসায়িক সাফল্য ও সম্মান
দেশের ২৯ টি রাজ্যের মধ্যে ২৩ টি রাজ্যে অরুণাচলমের নির্মিত প্যাড তৈরির মেশিন গৃহিত হয়েছে। এবার বিশ্বের ১০৬ টি দেশে এই মেশিন পাঠাবার কথা ভাবছেন অরুণাচলম। মহিলা স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে অরুণাচলমের এই সাফল্যকে কুর্ণিশ জানিয়ে, তাঁকে 'পদ্মশ্রী' সম্মানে ভূষিত করেছে ভারত সরকার।
অরুণাচলমকে নিয়ে হিন্দি ছবি
স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সমাজের বিরুদ্ধে লড়ে অরুণাচলমের এই কাহিনি এবার দেখা যাবে সেলুলয়েডের পর্দায়। 'প্যাডম্যান' নামের এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করতে চলেছেন অক্ষয় কুমার।