চিন-ভারতের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে বছরভর সরগরম থেকেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া
দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ব্যাটন কার হাতে থাকবে তা নিয়ে ভিতরে ভিতরে সারাক্ষণ লড়াই চলে ভারত-চিনের। সেটাতেই ঘি ঢেলেছে এবছর ডোকলাম নিয়ে চাপান-উতোর।
পাকিস্তানের সঙ্গে যেমন সারাক্ষণ সরাসরি যুদ্ধের আবহ লেগে রয়েছে, চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আবার সেরকম নয়। তবে প্রতিযোগিতা ও একে অপরকে দেখে নেওয়ার তাগিদ বোধহয় আরও বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ব্যাটন কার হাতে থাকবে তা নিয়ে ভিতরে ভিতরে সারাক্ষণ লড়াই চলে ভারত-চিনের। তাই আদতে প্রতিবেশী হলেও সম্পর্কের শৈত্যপ্রবাহ দীর্ঘ কয়েকদশক ধরেই বয়ে চলেছে। সেটাতেই ঘি ঢেলেছে এবছর ডোকলাম নিয়ে চাপান-উতোর।
ডোকলামে অবস্থান
এবছরের মাঝামাঝি ভারত-ভূটান-চিন সীমান্তের মাঝে ডোকলামের তরাই এলাকা চিন নিজেদের বলে দাবি করে সেখানে রাস্তা করতে যায়। তাতে বাধা দিয়ে ভারতের সেনা অবস্থান করায় ওই এলাকায়। যা নিয়ে ভারত-চিন যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল। ৭৩ দিন দুই দেশের সেনা ডোকলামে অবস্থান করার পর সমঝোতা করে পিছু হটেছে।
শুরু ডোকলাম বিতর্ক
জুনের শুরুতে চিন বিতর্কিত ডোকলাম তরাই এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে সেখানে রাস্তা তৈরি করতে উদ্যত হয়। ভূটান জানায়, এই এলাকা চিনের নয়। বস্তুত ভারত-ভূটান-চিন সীমান্তের মাঝের একটি বিতর্কিত অংশ এটি। আর সেজন্যই ভূটানের পাশে দাঁড়িয়ে ডোকলামে সেনা নামায় ভারত। চিনের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা আটকে দেওয়া হয়।
চিনা হুমকি
চিনের বারবার বলার পরও ভারত সেনা সরায়নি। সেজন্য চিনা সরকারি সংবাদপত্রে যুদ্ধের হুমকিও দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আলোচনার কথা বলে সেনা সরাতে অনড় থাকে নয়াদিল্লি। শেষপর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয় চিন।
ঝুঁকি বাড়িয়েছিল চিন
সিকিমের যে এলাকায় চিন রাস্তা তৈরি করতে উদ্যত হয় সেখান থেকে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের দূরত্ব খুব কম। এই এলাকার আর এক নাম 'চিকেনস নেক'। এর কাছাকাছি চিনকে ঢুকতে দিলে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তা বড় ঝুঁকি হয়ে যেত। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী এই এলাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে বা এই এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়লে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বিপন্ন হতো।
সীমান্ত নিরাপত্তা শিকেয়
শিলিগুড়িতে যে এলাকা গোটা ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ রক্ষা করে সেটাই শিলিগুড়ি করিডোর বলে পরিচিত। এর একদিকে রয়েছে নেপাল ও অন্যদিকে রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত। একটু উপরের দিকেই ভূটান, তিব্বত ও পর্যায়ক্রমে চিন সীমান্ত। ফলে এই এলাকা ভূটান, নেপাল, বাংলাদেশ, সিকিম, দার্জিলিং ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে গোটা দেশের সংযোগ রক্ষা করে চলেছে।
শিলিগিড়ি করিডোর
শিলিগিড়ি করিডোর এলাকা কিছু কিছু জায়গায় এতটাই সরু যে মাত্র ২৭ কিলোমিটার প্রস্থের ভারত সীমান্তের দুপাশে দাঁড়িয়ে নেপাল ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এখান থেকে ডোকলাম এলাকার দূরত্ব খুবই কম। চিনকে এই এলাকায় রাস্তা তৈরির সুযোগ দিলে তা বড় সঙ্কট তৈরি করতে পারত। যুদ্ধ বাঁধলে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
অবশেষে সরল চিন
অগাস্ট মাসে ৭৩ দিন পর উপায় না দেখে চিন সমঝোতা করতে রাজি হয় ভারতের সঙ্গে। ভারত-চিন দুপক্ষই সেনা সরিয়ে নেয়। আলোচনায় বসে। তবে তার কয়েকমাসের মধ্যেই ফের ডোকলাম এলাকায় চিনা সেনার দাপাদাপি শুরু হয়। নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে উপগ্রহ চিত্রে ফাঁস হয় চিন ডোকলামের অদূরে ফের রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে। এই নিয়ে ফের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র নিয়ে দুষ্টুমি অব্যাহত
এসবের মাঝে নভেম্বরের শেষে জানা যায়, চিন থেকে বয়ে আসা ব্রহ্মপুত্র নদীর জল কালো হয়ে গিয়েছে। পিছনে চিনের গোপন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত মেলে। নিজের দেশে তরাই এলাকায় গোপনে চিন ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ দিচ্ছে, সেজন্যই জল কালো হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ভারতকে চাপে রাখতেই এবার ব্রহ্মপুত্র ইস্যুতে চিন নয়া ফন্দি আঁটতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন যা অবস্থা তাতে ডোকলাম নিয়ে ভারত-চিন সম্পর্কের তাপউত্তাপ সামনের বছরও জারি থাকবে।