রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন কী? কেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ
রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন প্রয়োগ আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ এর এ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা যেত। তবে বর্তমানে যতদিন পর্যন্ত না ব্রিটিশ আমলের পুরনো এই আইন নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই আইনের প্রয়োগকে স্থগিত করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়েছে, যতদিন না আইন পুনর্বিবেচনা হচ্ছে, ততদিন এই আইনের ধারা অনুযায়ী কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এবং এখনও পর্যন্ত এই আইনের অধীন যে সমস্ত মামলা চলছে, তা স্থগিত হয়ে যাবে। এবং যারা এই আইনের ফলে বন্দিদশা ভোগ করছেন তারা জামিনের আবেদন করতে পারবেন।
প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকার এই ঔপনিবেশিক আইনের পক্ষে সওয়াল করলেও পরে জানিয়েছিল যে তারা এই আইন পুনর্বিবেচনা করছেন। সুপ্রিম কোর্ট প্রথমে কেন্দ্রের কাছে জানতে চেয়েছিল যতদিন পুনর্বিবেচনা চলছে ততদিন এই আইনে হওয়া মামলাগুলিকে স্থগিত রাখা যায় কিনা? অথবা রাজ্যগুলিকে এই আইন প্রয়োগে বিরত রাখা যায় কিনা। তবে এদিন সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি জানিয়ে দেয়, পুনর্বিবেচনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশদ্রোহিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের প্রয়োগ বন্ধ থাকবে। নতুন করে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এবং যারা গ্রেপ্তার হয়ে আছেন তারা জামিনের আবেদন করতে পারবেন। আপাতত এই ধারার আওতায় থাকা মামলাগুলিকেও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন কী বলছে?
সংবিধানের ১২৪ এর এ ধারা মোতাবেক কেউ যদি তার কথা অথবা লেখা অথবা অঙ্গভঙ্গি, আচার ব্যবহারের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো, আইন অমান্য, উস্কানি দেওয়া কাজ করেন বা করার চেষ্টা করেন যা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরুদ্ধ, তাহলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কারাদণ্ড এবং জরিমানা দুইই হতে পারে।
কীভাবে তৈরি হল এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন?
১৮৬০ সালে যখন ভারতীয় দণ্ডবিধি তৈরি করেছিলেন থমাস ম্যাকলে তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনকে সংযুক্ত করা হয়নি। পরে ১৮৯০ সালে সংবিধানের ১২৪ এর এ ধারা অনুযায়ী দেশদ্রোহিতার আইন সংযুক্ত করা হয় বিশেষ আইন মেনে।
প্রথমে রাষ্ট্রদ্রোহিতায় দোষী সাব্যস্ত হলে সাজা ছিল সাগর পাড়ি দিয়ে নিয়ে গিয়ে সাজা খাটানো। পরেও ১৯৫৫ সালে তা সংশোধন করে যাবজ্জীবন সাজা যুক্ত করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বারবার এই ধারার প্রয়োগ করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার। স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করতে বারবার এই ধারার প্রয়োগ করা হয়েছিল। বাল গঙ্গাধর তিলক, অ্যানি বেসান্ত, মহম্মদ আলি, মৌলানা আজাদ এবং মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা আইনে অভিযোগ করা হয়েছিল।
পঞ্চাশের দশকে রাষ্ট্র বনাম রমেশ থাপারের মামলায় স্পষ্ট জানানো হয়েছিল, সরকারের সমালোচনা করা অথবা তার কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করার অর্থ এই নয় যে কারও বাক এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আটকে দেওয়া উচিত। যদি না সেই বক্তব্য বা আচরণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অথবা সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে থাকে।
পঞ্চাশের দশকে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার হাইকোর্ট এবং অন্যদিকে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিভিন্ন মামলায় এটা স্পষ্ট জানিয়েছিল যে, ব্রিটিশ আমলে যে আইন তৈরি করা হয়েছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা, বিভেদ তৈরি করা। যার ফলে এই আইনকে কোনওভাবেই এখন ন্যায্য বলে দাবি করা যায় না।
যদিও ১৯৬২ সালে বিহারে কেদারনাথ সিংয়ের মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনকে কার্যত বৈধতা দেওয়া হয়। তবে সেখানে আদালতের তরফে গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, সরকারের বিরুদ্ধে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ঘৃণা অথবা রাগ প্রকাশের সমস্ত ধরন রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। তবে যদি কোনও বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আইনের অবনতি বা জনরোষ তৈরি হয় তাহলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য হতে পারে।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট নতুন করে এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য শুনবে। কারণ ইতিমধ্যে বেশকিছু পিটিশন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। যা নিয়ে বিচারে বসবেন সর্বোচ্চ আদালতের সাত সদস্যের বেঞ্চ।
এর আগে কেন্দ্রে তরফে আদালতে বলা হয়, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের অপব্যবহার হলেও এই আইনকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তবে এদিন আদালত ফের এই আইনকে পুনর্বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছে।
যুক্তরাজ্য ব্রিটেনের মতো দেশে রাষ্ট্রদোহিতা আইনকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডেরাল ক্রিমিনাল কোড অনুযায়ী দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে মূলত রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়াতেও এক দশকের বেশি সময় আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনকে তুলে দেওয়া হয়েছে। সিঙ্গাপুরেও এ রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন তুলে নেওয়া হয়েছে।