সোনিয়া গান্ধী ২০০৪কে মনে করাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অনেক আলাদা
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার দিনে, অর্থাৎ ১১ এপ্রিল, উত্তরপ্রদেশের নিজের রায় বারেলি কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন পেশ করতে গিয়ে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন।
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার দিনে, অর্থাৎ ১১ এপ্রিল, উত্তরপ্রদেশের নিজের রায় বারেলি কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন পেশ করতে গিয়ে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মোটেও অপরাজেয় নয় এবং উল্টে মিডিয়াকুলকে মনে করিয়ে দেন ২০০৪-এর সাধারণ নির্বাচনের কথা। সেবার সোনিয়ার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও শেষমেশ জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির বিজেপিকে পরাস্ত করে তারা ক্ষমতায় ফেরে আট বছর পরে। এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংকে সে পদে মনোনীত করেন সোনিয়া।
সাংবাদিকদের সঙ্গে এরপরে কথা বলতে গিয়ে মোদীকে তুলোধোনা করেন সোনিয়ার পুত্র এবং বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও। বলেন, ভারতের ইতিহাসে এর আগেও এমন মানুষ দেখা গিয়েছে যাঁরা নিজেদের অপরাজেয় এবং দেশের চেয়েও বড় মনে করত। তিনি বলেন মোদী গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষের জন্যে কিছুই করেননি এবং তিনি অপরাজেয় কি না, তা নির্বাচনের পরেই দেখা যাবে।
রায় বারেলির চারবারের সাংসদ সোনিয়া পাশাপাশি এও বলেন যে ২০০৪ সালে বাজপেয়ীকেও অনেকে "অপরাজেয়" বলে মানলেও শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তা সবাই জানে। রায় বারেলিতে এবারের নির্বাচন ৬ মে এবং সোনিয়ার প্রতিপক্ষ বিজেপির দীনেশ প্রতাপ সিং যিনি এর আগে কংগ্রেসে ছিলেন।
২০০৪ সম্পর্কে সোনিয়ার বক্তব্য অমূলক নয়। সেবারে সবাই প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন যে পাঁচ বছর চুটিয়ে রাজ করার পরে ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছেন বাজপেয়ী। তাঁর মতো দেশনেতার জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনও দ্বিমত ছিল না এবং বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দলের এক নরমপন্থী মুখ হিসেবে বাজপেয়ী অনেক দল এবং জোটসঙ্গীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিজেপির প্রচারেও সেবার 'ভারত উদয়' এবং 'শাইনিং ইন্ডিয়া' নামক অভিনবত্বের আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির তাবড় নির্বাচনী মাতব্বররা বুঝতেই পারেননি চোরাস্রোতের অস্তিত্ব এবং তার ফলে বাজপেয়ীর গণেশ ওল্টাতেও সময় লাগে না। সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক কেরিয়ারে সেটাই প্রথম বড় জয় এবং তিনি সেই স্মৃতিকে ভিত্তি করে যে ২০১৯-এও দলকে উজ্জীবিত করতে চাইছেন, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে ২০০৪-এর সঙ্গে এবারের লড়াইয়ের তফাৎ রয়েছে।
২০০৪-এর লড়াইতে মোদী নামক 'ফেনোমেনন'টি ছিল না
প্রথমত, বাজপেয়ী সেবার বিজেপির প্রধান সেনাপতি হলেও মোদীর নিরিখে তিনি কম জনপ্রিয়ই বলা চলে। এর কারণ, বাজপেয়ী ছিলেন প্রথাগত নেতা যিনি পরিশ্রম করে নির্বাচন জেতেন এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হওয়াতে পরাজিতও হন। মোদীর সময়ে কিন্তু রাজনীতির সমীকরণ অত সরলীকৃত আর নেই। মোদীর উত্থানের পিছনে কাজ করেছে এক বিরাট প্রচার -- যার অস্তিত্ব বাস্তবের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতেও এবং সেখানে তাঁকে হারানো সহজ কাজ নয়, অন্তত কংগ্রেসের মতো প্রথাগত লড়াইতে বিশ্বাসী দলের। আর মোদীর মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদকে, যিনি বিরোধীদের থেকে এগিয়ে থাকার জন্যে যে কোনও সময়ে গল্পের প্লট গুলিয়ে দিতে পারেন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়ায় হারানো সহজ নয়।
২০০৪-এ সোনিয়া পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে বিজেপিকে হারিয়েছিলেন; এবারে সেটা করে দেখানো কঠিন
দ্বিতীয় কথা, বাজপেয়ীর পরাজয়ের পিছনে অন্যতম বড় কারণ ছিল 'ইন্ডিয়ার' বাইরে যে ভারত, তার ক্ষোভ। শহর-ভিত্তিক এবং দক্ষিণপন্থা কেন্দ্রিক বিজেপিকে হারাতে সোনিয়া গান্ধীর জনদরদী ভাবমূর্তি এবং কর্মসূচি কাজে এসেছিল, যেমন এসেছিল তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম। কিন্তু এবারে বিজেপিকে স্রেফ শহর-ভিত্তিক দল বলা চলবে না; মোদী সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে আজ বিজেপি শহুরে জীবনের বাইরেও প্রভাব বাড়িয়েছে এবং তার মোকাবিলা করতে কংগ্রেসকে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
এবারে সোনিয়া নন, কংগ্রেসের কান্ডারি রাহুল যাঁর ভাবমূর্তি এখনও তত উজ্জ্বল নয়
তৃতীয়ত, সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের নেত্রী হিসেবে প্রশংসিত হলেও রাহুল গান্ধীর ভাবমূর্তি নিয়ে সন্দিহান এখনও অনেক ভারতীয়ই। তাছাড়া, গত ১৫ বছরে দেশজুড়ে কংগ্রেসের কাঠামো আরও দুর্বল হয়েছে এবং বিজেপির শক্তি বেড়েছে অনেকটাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪-এর পুনরাবৃত্তি খুব সহজ কাজ নয়।
চতুর্থত, ২০০৪-এ যে বাজপেয়ী সরকারের পতন হয়েছিল, সেটি ছিল একটি কোয়ালিশন সরকার। কিন্তু এবারে মোদী সরকার একাই যথেষ্ট বলিষ্ঠ এবং কংগ্রেসের গতবারের ফলাফল থেকে এক লাফে বিজেপিকে সংখ্যালঘিষ্ট করে ফেলা কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়।
[আরও পড়ুন:অন্ধ্রে ভোটপর্ব মিটল রাত ১টায়, ইভিএম গুটিয়ে কাকভোরে বাড়ি গেলেন ভোটকর্মীরা]