পৌষ পার্বণ মানেই বাঙালির পিঠে-পুলি উৎসব, এমনকিছু পিঠের রেসিপি যা জিভে জল আনে
বাংলার পিঠে-পুলি উৎসব মানে হাজারো রকমের আয়োজন। কী নেই তাতে সড়াই পিঠে থেকে শুরু করে পাটি-সাপটা, পুলি, ভাপা পীঠে। এর সঙ্গে জুড়ে দিন নলেন গুড়ের পায়েস।
বাঙালির বারো-মাসে তের পার্বণের আরও এক পার্বণ হল পৌষ-সংক্রান্তি। যা আবার পৌষ-পার্বণ নামেও পরিচিত। আর এমন পার্বণ মানেই পিঠে-পুলি-র উৎসব। বাঙালির রসনায় যে স্বাদের ভাগ হয় না।
[আরও পড়ুন:মকর সংক্রান্তিতে পুণ্যস্নান থেকে বিহু-লোহরির নাচে গানে আজ মাতোয়ারা গোটা দেশ ]
বাংলার পিঠে-পুলি উৎসব মানে হাজারো রকমের আয়োজন। কী নেই তাতে সড়াই পিঠে থেকে শুরু করে পাটি-সাপটা, পুলি, ভাপা পিঠে। এর সঙ্গে জুড়ে দিন নলেন গুড়ের পায়েস। বাঙালির রসনায় এমন মিষ্টি আর পিঠের স্বাদ দ্বিতীয়টি পাওয়া কঠিন।
সড়াই পিঠে
মাটির সড়াতে এই পিঠে তৈরি হয়। এটাও এক ধরণের ভাপা পিঠে। চালের গুড়োকে ভালো করে জল দিয়ে ঘন করে গুলে নেওয়া হয়। একটু হালকা করে নুনও ফেলে দেওয়া হয় এতে। এরপর গরম মাটির সড়াতে ছোট ছোট গর্তের মতো খোপগুলি ওই চালের গোলা দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়। এই কাজ শেষ হলে সড়াটির মাথায় মাটির ঢাকনা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর এর চারপাশ দিয়ে এক ছটাক জল ফেলে দেওয়া হয়। মিনিট চারেক পরে পরে ঢাকনা খুলে নিলেই তৈরি সড়াই পিঠে। নলেন গুড় দিয়েও এই পিঠে খাওয়া যায়। এছাড়া দুধ বা ক্ষীরের মধ্যে খানিক্ষণ ফুটিয়ে নিয়েও খাওয়া যেতে পারে।
গোকুল পিঠে
ঘি-র মধ্যে ক্ষীর ও নারকেল-কে ভালো করে ভেজে নিতে হয়। এমনভাবে ক্ষীর ও নারকেল কষাতে হয় যাতে তা দিয়ে মণ্ড বানানো যেতে পারে। উনুন থেকে নামানোর পর ক্ষীর ও নারকেলের মিশ্রণকে ছোট ছোট গোল আকৃতির করতে হয়। এরপর গোলা আকৃতির মণ্ডগুলিকে হাত দিয়ে চেপ্টে নিতে হয়। কড়াই-এ ঘি ফেলে ভাজতে হয়। হালকা করে ভেজে নিয়ে চিনির রসে ফেলে দিলেই তৈরি গোকুল পিঠে তৈরি।
পাটি-সাপটা
পিঠে-পুলি পার্বণের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। পৌষ-পার্বণে কেউ অন্তত পাটি-সাপটা মুখে তুলবেন না এমন হয় না। পরিমাণ মতো চালের গুড়ো বা আটার সঙ্গে সামান্য ময়দা মেশান। এরপর তাতে গরম জল ঢেলে দিন। একটু চিনি মেশান। সাদা রঙ আনতে অল্পপরিমাণ দুধও দিতে পারেন। এরপর এগুলির মিশ্রণে ভালো করে গোলা তৈরি করে নিন। ফ্রাই প্যান গরম করে হালকা তেল দিয়ে ভাল করে মাখিয়ে নিন। এবার গোলা থেকে একটু গোলা তুলে আমলেট করার মতো করে ফ্রাই প্যানে ছড়িয়ে দিন। এরপর আগে থেকে বানিয়ে রাখা নারকেল-এর পুর অথবা ক্ষীরের পুর থেকে সামান্য অংশ নিয়ে ফ্রাই প্যানে দেওয়া গোলার মাঝখান থেকে লম্বা করে দিয়ে দিন। আমলেট ভাজার জন্য যেভাবে খুন্তি দিয়ে মোড়াতে থাকেন সেভাবে মোড়াতে থাকুন। পুরোপুরি মোড়া হয়ে গেলে হালকা আঁচে কিছুক্ষণ রেখে হালকা লাল হলেই নামিয়ে নিন। ব্যাস তৈরি আপনার স্বাদের পাটি-সাপটা।
পুলি
কড়াই বা হাড়িতে অল্প জল গরম করুন। এরমধ্যে খানিকটা ঘি এবং লবণ দিয়ে দিন। জল ফুটতে শুরু করলে এরমধ্যে চালের গুড়ো ফেলে দিন। আঁচ নিবিয়ে এবার ভালো করে এই মিশ্রণটাকে মেখে নিন। রুটি করার সময় আটা যেমন নরম থাকে অথচ লিচি করা যায় তেমন হতে হবে। এরপর ছোট-ছোট লিচি করে নিয়ে সেগুলিকে রুটির আকারে বেলে নিন। অথবা গোলাকার লিচিকে চ্যাপ্টা .করে নিয়ে তাতে বুড়ো আঙুল দিয়ে গর্তের মতো করে নিন। এরপর তাতে নারকেল-এর পুর ভরে দিয়ে চারপাশটা এঁটে দিন। এরপর ভাঁপে সিদ্ধ করে গরম গরম পরিবেশ। তৈরি পুলি। খাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে নিন নলেন গুড়।
মালপোয়া
গরম গরম মালপোয়া কার না ভালো লাগে। ছোট্টবেলায় উনুনের সামনে ঠাকুমা আর তাঁকে ঘিরে থাকা নাতি-নাতনীদের ভিড়। উনুনের উপরে কড়াই থেকে এক এক করে গরম মালপোয়া এসে পড়ছে নাতি-নাতনিদের পাতে। এমন ছবি নস্টালজিক করে তোলে। না হলে ভানু-র সেই বিখ্যাত ডায়লগ 'মাসিমা মালপোয়া খামু!' লোকের মুখে ফিরত না। মালপোয়া বানাতে যা দরকার তা হল ফুটন্ত দুধ। এরমধ্যে ময়দা ফেলে মিশ্রণটাকে মাখিয়ে নিন। বেশ পাতলা বা ঘন করবেন না। এরপর উনুনে বসানো কড়াইয়ে ঘি ফেলে দিন। ঘি গরম হয়ে গেলে এরমধ্যে দুধ ও ময়দার মিশ্রণ অল্প অল্প করে ফেলে দিন। ছোট্ট ছড়ানো রুটির মতো সেগুলি ঘি-তে ভাজতে থাকুন। ভাজা হয়ে গেলে তা উনুন থেকে নামিয়ে চিনির সিরায় ডুবিয়ে দিন। তৈরি হয়ে গেল মালপোয়া। পরিবেশনের সময় সিরা থেকে তুলে মালপোয়ার উপরে কেশর থেকে কাজু-কিশমিশ দিয়ে টপিংও করে দিতে পারেন। এতে স্বাদ আরও বেড়ে যাবে।
দুধের পুলি
পুলি বানিয়ে ফেলুন। এর আগে বা পরে ঘন করে দুধ জ্বাল দিন। দুধের মধ্যে ক্ষীরও দিতে পারেন। এছাড়াও চিনির বদলি হিসাবে খেজুরের গুড় দিতে পারেন। দুধ ঘন হয়ে এলে এরপর পুলিগুলিকে তাতে ছেড়ে দিন। কিছুক্ষণ পুলিশ ও দুধ একসঙ্গে জ্বাল দিন। ব্যাস তৈরি আপনার দুধের পুলি।
রাঙা আলুর পান্তুয়া
রাঙা আলু প্রেসারকুকারে সিদ্ধ করে নিন। আলুসিদ্ধ মাখার মতো করে রাঙাআলুগুলিকে চটকে দিন। এরপর তাতে সামান্য ময়দা ও চিনি মেশান। মাখা সম্পূর্ণ হলে ছোট ছোট লিচি করে নিন। এরপর প্রতিটি লিচিতে নারকেল বা ক্ষীরের পুর ভরে দিন। পুরভর্তি লিচিগুলিকে হালকা সাদা তেলে মাখিয়ে নিন। এরপর এমনি ময়দায় লিচিগুলি মাখিয়ে নিন। কড়াইয়ে ভর্তি গরম তেলে একটা একটা ছেড়ে ভেজে নিন। এই কাজ সম্পূর্ণ হলে চিনির সিরিয়া ডুবিয়ে দিন। ব্যস তৈরি হয়ে গেল রাঙা আলুর পান্তুয়া।
ক্ষীরপুলি
যে ভাবে পুলি এবং দুধের পুলি বানান। সেই একই পদ্ধতি। শুধুমাত্র কিছু উপকরণের অদল-বদল। পুলিতে নারকেলের পুরের বদলে ক্ষীরের পুর দিন। আর পুলি তৈরি হয়ে গেলে দুধ আর ক্ষীর মিশিয়ে গ্রেভি তৈরি করুন। এই গ্রেভি ঘন হয়ে এলে তাতে ক্ষীরের পুলিগুলি ছেড়ে দিন। হয়ে গেল ক্ষীরপুলি।।
রস বড়া
রাঙা আলু সিদ্ধ করে চটকে নিন। এবার তাতে ময়দা ও চালের গুলো মিশিয়ে নিন। ময়দা মাখার মতো মেখে নিন। এরপর সেগুলিকে ছোট ছোট বলের আকার করে নিন। কড়াইয়ে গরম তেলে এই বলগুলি ভেজে নিন। সিরায় ডুবিয়ে রাখুন। ঠান্ডা হয়ে গেলে পরিবেশন করুন।
নলেন গুড়ের পায়েস
দুধ পরিমাণ মতো জ্বাল দিয়ে ঘন করুন। এতে পরিমাণ মতো ক্ষীর মিশিয়ে দিন ভালো করে নাড়তে থাকুন। দুধ ঘন হয়ে এলে তাতে আতপ চাল দিন। খেয়াল রাখবেন চালের পরিমাণ। যতখানি দুধ তার একভাগের অর্ধেক পরিমাণ চাল নিতে হবে। চাল সিদ্ধ হয়ে এলে এবার নলেনের গুড় দিন। ভাল করে নাড়তে থাকুন। মিষ্টির পরিমাণ চেখে নিন। ছোট এলাচও দিয়ে দিতে পারেন। এতে স্বাদ বাড়বে। উনুন থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। এরপর পরিবেশন করুন নলেন গুড়ের পায়েস।
চিতোই পিঠের পায়েস
পরিমাণ মতো গরম জলে অল্প চালের গুড়ো দিয়ে ফুটিয়ে নিন। খানিক ফোটার পর উনুনের আঁচ কমিয়ে দিন। এরপর ওই চাল ও গরম জলের মিশ্রণে বাকি চালের গুড়ো ফেলে ভালো করে গুলে নিন। যেন আঠালো গোলা তৈরি হয় এভাবে গুলে নিতে হবে। মাঠির সড়াকে উনুনে চাপিয়ে তাতে হালকা করে তেল মাখিয়ে নিন। এবার চালুর গোলা হাতাতে করে গরম সড়ায় ঢেলে ঢাকনা চাপিয়ে দিন। ঢাকনার চারপাশ দিয়ে হালকা করে জল ছিটিয়ে দিন। খানিক পরে নামিয়ে নিন। এভাবে বেশকিছু পিঠে বানিয়ে নিন। এবার গরম জলে পাটালি গুড় দিয়ে দিন। এটাকে ফুটিয়ে নিন। পাটালিগুলো জলের সঙ্গে মিশে গেলে উনুন থেকে নামিয়ে নিন। এবার একটি হাড়িতে দুধ, চিনি, এলাচ, দারচিনি অকসঙ্গে জ্বাল দিন। দুধটা হালকা ঘন হলে পিঠেগুলি এতে ছেড়ে দিন এবং উনুন নিবিয়ে দিন। এরপর পিঠে থাকা দুধের মধ্যে আগে থেকে জ্বাল দেওয়া গুড়ের তরলটা ঢেলে দিন। সঙ্গে নারকেল কোড়া দিতে পারেন। এরপর ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঢেকে রেখে দিন। পিঠে নরম হলে পরিবেশন করুন।