তেলাঙ্গানা : মোদী কেসিআরকে কিছুই বলেন না; নির্বাচন-পরবর্তী রাস্তা খোলা রাখছেন?
সোমবার, পয়লা এপ্রিল, তেলাঙ্গানা রাজ্যের উপরে শ্যেন দৃষ্টি ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস দু'পক্ষেরই। আগামী ১১ এপ্রিল আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফাতে তেলাঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ - এই দুই রাজ্যেই নির্বাচন।
সোমবার, পয়লা এপ্রিল, তেলাঙ্গানা রাজ্যের উপরে শ্যেন দৃষ্টি ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস দু'পক্ষেরই। আগামী ১১ এপ্রিল আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফাতে তেলাঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ - এই দুই রাজ্যেই নির্বাচন। তার দিন দশেক আগে তেলাঙ্গানার মাটিতে দাঁড়িয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ শানালেন বিজেপি, কংগ্রেস এবং রাজ্যের শাসকদল তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির (টিআরএস) শীর্ষনেতৃত্ব।
লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যতটা না তাঁর প্রাক্তন জোটসঙ্গী চন্দ্রবাবু নাইডুকে আক্রমণ করেন রাজনৈতিক আঙিনায়, টিআরএস প্রধান কে চন্দ্রশেখর রাওকে কিন্তু করেন না। এমনকী, তিনিও বিজেপি এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধাচরণ করলেও নয়।
সোমবারও মোদী সেই কৌশলই নিলেন। তেলাঙ্গানার সেকেন্দ্রাবাদ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রিতে ভাষণ দেওয়ার সময়ে তিনি তেলুগু দেশম পার্টির (টিডিপি) নেতা তথা অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবুকে আক্রমণ করলেন, নিজের সরকারের হয়ে গলা ফাটালেন কিন্তু ওই পর্যন্তই। অন্যদিকে, কংগ্রেস সভাপতি তেলাঙ্গানার তিনটি জায়গায় নির্বাচনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরাসরি আঙ্গুল তুললেন কেসিআর-এর দিকে। বললেন টিআরএসকে ভোট দেওয়া মানে আসলে বিজেপি-আরএসএসকেই ভোট দেওয়া। কেসিআরকে একহাত নিয়ে বলেন যে মোদী সরকারের বিতর্কিত নোটবন্দি বা জিএসটি নীতি বা রাফালে নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ করেন না তেলাঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী। মোদী এবং কেসিআর-এর রাজনীতিকেও তিনি নাটক বলে কটাক্ষ করেন।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে তেলাঙ্গানাতে কয়েক মাস আগে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে কেসিআরকে হারাতে জোটবদ্ধ হয় টিডিপি, কংগ্রেস এবং আরও কয়েকটি দল কিন্তু তাতে কিছুই লাভ হয় না। মুখ থুবড়ে পড়ে সেই জোট এবং বিজেপিও বিশেষ সুবিধে করতে পারে না। রীতিমতো দাপটের সঙ্গে ক্ষমতায় ফেরেন কেসিআর। আর খুব বড় অঘটন না ঘটলে আগামী ১১ এপ্রিলও যে তেলাঙ্গানা রাজ্যে কেসিআর ভালো ফল করতে চলেছে তা নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই।
টিআরএস-এর প্রতি মোদীর নরমপন্থা আদতে কি সুযোগের সন্ধান?
যেটা বোঝার সেটা হল চন্দ্রবাবুর প্রতি মারকাটারি মনোভাব নিয়ে চললেও কেসিআর-এর প্রতি বিজেপির ধীর-স্থির নীতি। অতীতেও দেখা গিয়েছে মোদীকে সংসদে কেসিআর-এর প্রশাসক হিসেবে প্রশংসা করতে। অন্যদিকে, রাহুল গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন সংসদে, তখন টিআরএস শিবিরে শোনা যায় তার সমালোচনা। তবে কি বিজেপি-টিআরএস-এর মধ্যে কোথাও একটা দৃঢ় বন্ধন রয়েছে যা খালি চোখে দেখা যায় না? যে বিজেপি গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতা বাগাতে যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে, তারা আশ্চর্যরকমভাবে তেলাঙ্গানার স্থানীয় নেতৃত্বকে নিরুৎসাহ করেছে শাসকদলকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখা থেকে।
এর পিছনে কৌশল সুচিন্তিত। দেশে এখন দু'টি তেলুগু-ভাষাভাষীদের রাজ্য এবং যেখানে চন্দ্রবাবু ইতিমধ্যেই অন্ধ্রপ্রদেশকে বিশেষ তকমা দেওয়ার বিষয়টিকে তেলুগু খণ্ডজাতীয়তাবাদের জিগির তুলে বিজেপির বিরুদ্ধাচরণে নেমে পড়েছেন, সেখানে অপর তেলুগু নেতা কেসিআরকে চটানো মানে তেলাঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশে নিজেদের বিস্তারের সমস্ত সুযোগ হাতছাড়া করা।
এক চন্দ্র দ্বারা আরেক চন্দ্রের গ্রহণের প্রচেষ্টা
বিজেপি নেতৃত্ব তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারার এক কৌশল নিয়েছেন। একদিকে, কেসিআরকে বড় প্রশাসকের তকমা দিয়ে চন্দ্রবাবুর উচ্চতাকে খর্ব করার প্রচেষ্টা। চন্দ্রবাবুই ভারতের প্রথম টেক-স্যাভি রাজনৈতিক হিসেবে খ্যাত যিনি হায়দ্রাবাদ অঞ্চলকে উন্নত করার দাবি করে থাকেন; অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের উন্নয়নের কৃতিত্ব নেওয়ার প্রচেষ্টা করেন। তাঁকে তাঁরই সরকারের একসময়কার পরিবহণমন্ত্রী কেসিআর-এর সামনে প্রশাসক হিসেবে খাটো করার মধ্যে বিজেপির চন্দ্রবাবু-বিরোধী ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার এক আকুতি রয়েছে। তাছাড়া, রাজ্যের বিশেষ তকমা ইস্যুতে চন্দ্রবাবু বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে দু'পক্ষের মধ্যে মিলমিশের সম্ভাবনা অন্তত এই মুহূর্তে তো দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচন-পরবর্তী জোটের সম্ভাবনা খোলা রাখা
কেসিআর-এর প্রতি বিজেপির নরম-সরম অবস্থান নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে ভবিষ্যতের দরজা খোলা রাখা। যদি লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর পরে দেখা যায় যে বিজেপির কিছু আসন প্রয়োজন, তাহলে কেসিআর-এর দলের সঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী জোটের রাস্তা খুলে রাখার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই বলেই মনে করে পদ্মদল। তেলাঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশে ২০১৪ সালে বিজেপি মাত্র তিনটি আসন জিতেছিল আর এবারে তা বিশেষ না বাড়লে আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে জোটবন্ধনই বড় কৌশল হবে। কেসিআরকে মোদী-বিরোধী জোটের নানা মঞ্চে কিন্তু দেখা যায় না আর তাই তার মধ্যে পরবর্তী জয়ললিতার, যিনি কিনা নিজের স্বার্থে কেন্দ্র সরকারকে যখন তখন নাকে দড়ি পরিয়ে ঘোরাতে পারতেন, ছায়া কেউ লক্ষ্য করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
রাহুলের কেসিআর বিরোধিতা সেখানে সোজাসাপ্টা রাজনীতি
অন্যদিকে, রাহুল গান্ধীর রাজনীতি অনেকটাই সোজাসাপ্টা। তিনি যেহেতু চন্দ্রবাবুর হাত ধরেছেন দেশজুড়ে মোদী বিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলার তাগিদে, তাই মোদী নিয়ে কেসিআর-এর মৌনতা তাঁকে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো পীড়া দেয়। আর তাই মোদীর পাশাপাশি তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য হন টিআরএস সুপ্রিমোও। কিন্তু রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক কৌশলের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেন ওয়াইএসআর কংগ্রেস। যদি আগামী নির্বাচনে জগন্মোহন রেড্ডির দল চন্দ্রবাবুর দলকে বড়সড় ধাক্কা দেয় (অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনও লোকসভার সময়তেই), তাহলে জাতীয় স্তরে চন্দ্রবাবুর পতন অনিবার্য আর সেক্ষেত্রে বিজেপি-কেসিআর-এর নির্বাচন-পরবর্তী সখ্য গভীর হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটাই। সেক্ষেত্রে প্রকৃত পরাজিত নায়ক হবেন একজনই: রাহুল গান্ধী।