মেয়াদের মধ্যলগ্নে দাঁড়িয়ে মোদীর নোট বাতিলের ঘোষণা আদতে রাজনৈতিক 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'
আজকের টুইটার-ফেসবুকের 'তৎক্ষণাৎ'-এর যুগে তাঁর সিংহগর্জনই মানুষ মনে রাখবে, নীতির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল নয়, সেটা আধুনিক রাজনীতিবিদ মোদী খুব ভালো করে জানেন
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিল করে দেওয়ার পরে সারা দেশে তাঁর জয়গান শুরু হয়ে গিয়েছে। "এই না হলে লিডার," জাতীয় নানা মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরে নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহেই এই অর্থনৈতিক পদক্ষেপ এক ধাক্কায় মোদীর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিকে যে আরও ফুলিয়ে তুলবে জনমানসে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
কিনতু মোদীর এই পদক্ষেপ আদতে কতটা অর্থনৈতিক?
মোদীর এই ঘোষণা আসলে একটি রাজনৈতিক 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'। মোদী এখন তাঁর মেয়াদের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছেন কিনতু যেই সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৪তে তার অনেক কিছুই তিনি এখনও পূরণ করে উঠতে পারেননি। এই যেমন, অর্থনীতিতে বিপুল সংস্কার। রাজনৈতিক কারণে প্রায়ই আটকে থাকছে সেই পরিকল্পনা।
মোদী জানেন ভালো করেই যে 'কুইক অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স'
আর তাই, প্রয়োজন ছিল এমন একটা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার উপলক্ষ্যের। আর সে কাজটা মোদী করলেন প্রায় নির্ভুলভাবেই। বা বলতে গেলে, নিজের মেয়াদের মধ্যলগ্নে ঝালাই করে নিলেন নিজের জনসমর্থন। সামনে উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে এই সমস্ত কার্যাবলী সম্পাদিত করাও কৌশলগতভাবে জরুরি ছিল মোদীর কাছে।
প্রধানমন্ত্রী জানেন যে রাজনীতিতে সাফল্য ধারাবাহিকভাবে পেতে হয় না হলে টিকে থাকা মুশকিল। যদিও এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী অন্তত জাতীয় স্তরে নেই, কিনতু তাও মোদী অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের পতন নিজেই ডাকতে রাজি নন।
OROP, কালো টাকা ইত্যাদি প্রতিশ্রুতিকে আশামাফিক পালন না করতে পারার দুশ্চিন্তা
আর তাছাড়া, OROP(one rank one pension) ইত্যাদি সংবেদনশীল বিষয়ে মোদী গত লোকসভা নির্বাচনের আগে যে বিশাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলপ্রসূ না হওয়াতে অনেক প্রাক্তন সেনাকর্মীই হতাশ এবং ক্ষিপ্ত। সম্প্রতি এই নিয়ে একজন প্রাক্তন জওয়ানের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করেও বিরোধীরা ময়দানে নেমে পড়েছে। এই সমস্তকে সামলাতে মোদীকে কিছু একটা আবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকমাফিক করতেই হত। আর তিনি তাই করলেন মঙ্গলবার রাতে।
OROP-এর পাশাপাশি মোদীর দায়বদ্ধতা ছিল কালো টাকা ফেরত আনার ব্যাপারেও। এই বিষয়েও গত লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি এবং তাঁর দল আগের ইউপিএ সরকারকে বিঁধে সাধারণ মানুষকে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন। কালো টাকা ফিরিয়ে আনার ফলে সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্ক একাউন্টে টাকা আসবে সেই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি। বিরোধীরা সুর ছড়িয়েছে। মোদীর 'সুপারম্যান' ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল বিজেপির।
রাজনীতিতে পার্সেপশন বড় বস্তু আর মোদীর পিআর মেশিনারি তা জানে ভালো মতো
রাজনীতিতে পার্সেপশন একটি বড় বস্তু এবং নরেন্দ্র মোদীর জনসংযোগ মেশিনারি গত আড়াই বছর ধরে এই পার্সেপশনের ব্যাপারটির বেশ ভালো যত্ন-আত্তি করেছে। বিশেষ করে, বিদেশনীতিতে মোদীর সক্রিয় ভূমিকা যে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছে তা বিশ্বাস করেছে সবাই।
কিনতু কালো টাকা বা আরোপ-এর ক্ষেত্রে সেই একই বিশ্বাস তৈরি করতে হিমশিম খেয়েছে গেরুয়া শিবির। আর তার জন্যই মোদীকে স্বয়ং এগিয়ে আসতে হয়েছে নোট বাতিল করতে। কালো টাকা ফিরিয়ে আনতে না পারি, তৈরি করতেই দেব না, বার্তাটা এরকম। আবার সেই পার্সেপশনকে অবলম্বন করেই এগোলেন প্রধানমন্ত্রী।
কামড়ান না কামড়ান, হালুম তো করলেন; ভক্তদের কাছে তাই যথেষ্ট
এই টুইটার-ফেসবুকের 'তৎক্ষণাৎ'-এর যুগে নীতির দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল নিয়ে কেউ ভাবে না। শুরুটাই দেখে হাততালি দেয় আর তারপরেই পয়সা হজম। ব্যস্ত, ক্রেডিট কার্ড-সর্বস্ব মধ্যবিত্তের কাছে মোদীর এই উদ্যোগী পুরুষসিংহের আবেদনটাই সবচেয়ে বড়। আর তিনি কামড়ান না কামড়ান, সিংহগর্জন যে করলেন, এতেই নিশ্চিন্ত তাঁর সমর্থকরা।
এটা প্রকারান্তরে ২০১৯-এর নির্বাচনের হালকা প্রচার; এবার বিরোধীদের পালা
আজকে প্রধানমন্ত্রীর এই নোট বাতিলের ঘোষণার পরেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ কংগ্রেস, বাম, কেজরিওয়াল অনেকেই এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষে নিজেদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে এটা পরিষ্কার যে মোদীর এই 'রাজনৈতিক' ঘোষণার গুরুত্ব বিরোধীরা বুঝেছেন। ২০১৯কে সামনে রেখে দু'পক্ষ এবার কীভাবে ঘুঁটি সাজায়, এখন দেখার সেটাই।