ইউপিএর পতন থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার
রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে প্রথম সাক্ষাৎকার দিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে প্রথম সাক্ষাৎকার দিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসী রাজনীতি থেকে ইউপিএ সরকারের আমলের নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তাঁর কথায়। ভবিষ্যতে কোন পথে কংগ্রেসকে এগোতে হবে সেই পথের সন্ধানও দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় পাঁচদশকের রাজনৈতিক জীবন প্রণবের। কংগ্রেসের চাণক্য বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরই দলের ভরাডুবি হয়েছে। নানা আলোচনায় সেই সমস্ত প্রসঙ্গে সোজা জবাব দিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি।
কেন ২০১৪ সালে পুরোপুরি ভরাডুবি হল কংগ্রেসের?
ইউপিএ-১ এ জোট সরকার দারুণ চলেছিল। যদিও কংগ্রেসের নিজেদের আসন ছিল ১৪৭। বাম, সমাজবাদী পার্টি, সোসালিস্টরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছিল। সবকিছু ঠিক ছিল। তবে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের জোট ভালো হয়নি। সেটাই কংগ্রেসের মুখ থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
কেন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার মুখ থুবড়ে পড়েছিল?
২০০টি আসন জিতেই কংগ্রেস ভেবেছিল ২৮০টি জেতা হয়ে গিয়েছে। ফলে আত্মতুষ্টি এসে গিয়েছিল। ২০১২ সালে মমতা জোট ছেড়ে বেরিয়ে যান। সেইসময়ে তাঁকে সামলানো কঠিন ছিল। মমতার কাছে ১৯জন লোকসভা সাংসদ ছিল। অন্যতম বড় সঙ্গী ছিল। মমতার সঙ্গে আমার ঝগড়াও হয়। তা সত্ত্বেও জোটে ওকে ধরে রাখতে পেরেছিলাম। আমি জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে অক্টোবরে ও জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এর থেকে খারাপ অবস্থা হয়েছিল প্রথম ইউপিএ আমলে। তবে তা সামলে নিতে পেরেছিলাম। পরেরবার পারিনি।
আপনি বুঝেছিলেন কংগ্রেস ২০১৪ সালে হারতে চলেছে?
নির্বাচন চলাকালীন অনেক কংগ্রেস নেতা আমার সঙ্গে দেখা করে মতামত জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছিলেন কংগ্রেস ১৬০-১৭০টি আসন পাবে। বিজেপি পাবে ১৮০টি। তবে একমাত্র পীযূষ গোয়েল বলেছিলেন যে বিজেপি ২৬০টির বেশি আসন পাবে। এবং তিনিই একমাত্র সঠিক ছিলেন।
সোনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক
প্রথমদিকে সোনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই সাধারণ ছিল। তবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। পাঁচমারীর ঘটনায় আমার ভূমিকা দেখে সোনিয়া দূরত্ব মিটিয়ে ফেলেন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি কখনও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন না। যা জানেন না তা স্বীকার করে নেন।
মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মর্মাহত
আমার মনে হতো, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমি যোগ্য নই। তার তিনটে কারণ রয়েছে। আমি ২০০৪ সাল বাদে কখনও রাজ্যসভা বাদে লোকসভা থেকে জিতিনি। আমি হিন্দি জানি না। হিন্দি না জানলে প্রধানমন্ত্রিত্ব করা যায় না। এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে থেকে রাজনীতি করেছি অথচ ১৯৭৭ সালের পর থেকে কখনও কংগ্রেসের শাসন তৈরি করতে পারিনি। প্রত্যেকটি প্রধানমন্ত্রী তাদের রাজ্যের সমর্থন পেয়েছে। যা আমি কখনও পেতাম না। কারণ কংগ্রেস বাংলায় শাসনে ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন কেমন
মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সেরা পছন্দ ছিল। তাঁর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল। অর্থনীতিতে তাঁর জ্ঞান সর্বজনবিদিত। সেইসময়ে ওঁনার চেয়ে যোগ্য আর কেউ হতে পারতেন না। মনমোহনের সঙ্গে কাজ করতেও আমার কোনও অসুবিধা হয়নি।
ইউপিএ দুইয়ে প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ
আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। আমি নাম বলতে চাই না। তবে অনেক মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জোট সরকারের অনেক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সকলের সমর্থন ছাড়া চলা যায় না। অনেকের অনেক অনুরোধ শুনতে হয়। নাহলে সরকার পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আমরা সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে এবাবে পতন হবে ভাবিনি।
রাহুলের সভাপতি হওয়া প্রসঙ্গে
রাহুল উঠে আসছে। পরিশ্রম করছে। কংগ্রেসীদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি দায়িত্বে আসবেন কিনা। এটা ১৩২ বছরের পুরনো দল। সকলে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। সকলে মিলেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র থাকলেও তা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে হওয়া উচিত। প্লেনারি সেশনে সদস্যদের ভোটে মনোনয়ন জমা করে কংগ্রেস সভাপতি বেছে নিতে হবে। সঠিক পদ্ধতি না হলে মুখ থুবড়ে পড়ার ভয় রয়েছে।
কংগ্রেস কী ফিরে আসবে?
১৩২ বছরের দলকে আপনি চাইলেই সরিয়ে ফেলতে পারবেন না। কংগ্রেস ফিরে আসবে। তবে পরিস্থিতির বদলের জন্য কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের পরিশ্রম করতে হবে। প্রযুক্তিকে আপন করে নিতে হবে। মোবাইলের ব্যবহার জীবনকে বদলে দিয়েছে। ফলে দল হিসাবে সব ধরনের প্রযুক্তিকে আপন করতে হবে। তার মধ্য দিয়ে বদলের পথ খুঁজতে হবে।
৪৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষা
সংসদে আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্ত পৌঁছতে হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সফলতার এটাই সহজ রাস্তা। এটা সকলকেই শিখতে হবে। রবি ঠাকুরের কথায় বলতে পারি, যা দিয়েছি, পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি।