চ্যানেল নিষিদ্ধ: মিডিয়া বা সরকার কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়
অতিরিক্ত গণতান্ত্রিক সুযোগসুবিধা নিতে গিয়ে আজ এদেশের মিডিয়া যেমন তার সংযম হারিয়েছে, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও কোনও হেলদোল দেখা যায়নি এই বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে; তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
গণতন্ত্র যেহেতু 'যত মত, তত পথ'-এর কথা বলে, তাই এই ব্যবস্থায় শেষ সত্য বলে কোনও পদার্থের দেখা পাওয়া যায় না বিশেষ। সবই আপেক্ষিক, তুল্য-মূল্য বিচারে মেপে দেখা হয়। আর তাই গণতন্ত্রে তর্কের কোনও শেষ নেই। বিশ্বাসে মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
সম্প্রতি, কেন্দ্রীয় সরকার এনডিটিভি হিন্দি চ্যানেলকে পাঠানকোট সন্ত্রাস-বিরোধী অপারেশনের সম্প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে একদিনের জন্য নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বভাবতই চারিদিকে ছিছিক্কার পড়ে গিয়েছে। "এত জরুরি অবস্থায় ফিরে যাওয়ার মতো," প্রশ্ন অনেকেরই।
কোনও অবস্থাতেই সংবাদমাধ্যমের উপরে বিন্দুমাত্র নিষেধাজ্ঞা চাপানো গণতন্ত্রের পরিপন্থী, বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। সরকার পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে যে নিছক রাজনীতি করার জন্যই এই বিরোধিতা করা হচ্ছে। জরুরি অবস্থার সময়ে যা হয়েছিল, তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও মিল নেই।
দু'পক্ষের এই তর্কবিতর্ক শুনে মনে হচ্ছে প্রকৃত সত্য কে বলছে বা আদৌ প্রকৃত কোনও সত্য বলে কি কিছু হয় গণতন্ত্রে? নাকি লাগামছাড়া স্বাধীনতা উপভোগ করতে করতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াটাই গণতন্ত্রের নিয়ম?
আজকের ভারতীয় মিডিয়া যে যা খুশি তাই করে চলেছে তা অস্বীকার করা যায় না
একথা অনস্বীকার্য যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারতের মিডিয়াকুলের কাছে লক্ষণরেখা বলে কিছু নেই। সব বিষয়ে ঢক্কানিনাদ আজ এদেশের সংবাদমাধ্যমের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের 'যা খুশি তাই' পরিবেশে কোথায় থামতে হয় তা আজকের টিআরপি-সর্বস্ব সংবাদমাধ্যম বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছে। ক্রিকেট থেকে বলিউড, নরেন্দ্র মোদী থেকে পাকিস্তান -- সবই বিকোচ্ছে খোলা বাজারে 'হট কেক'-এর মতো। আর সংবাদকে মধ্যবিত্তের স্থায়ী খোরাক করে তুলতে গিয়ে কোনও বাধাই আর মানতে রাজি নয় এই সংবাদ ব্যবসা।
সন্ত্রাসবাদ-এর মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও সংবাদমাধ্যমের নাকগলানো চলছে অবিরত। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে মুম্বইতে আজমল কাসাব এবং টানে সাঙ্গপাঙ্গরা হাড়-হিম করা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ করার পরেও ভারতের সংবাদমাধ্যম এই একই কান্ড ঘটিয়েছিল। এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অপারেশনের লাগামছাড়া সম্প্রচার করে শত্রুপক্ষের সুবিধে করে দেওয়ার অভিযোগে নিন্দিতও হয়েছিল।
কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে জরুরি অবস্থার কোনও মিল নেই
সেই
ঘটনার
প্রায়
আট
বছর
পরে
ফের
আরও
একটি
চ্যানেলের
বিরুদ্ধে
সেই
একই
অভিযোগ
উঠল
এবং
মোদী
সরকার
তাকে
একদিনের
জন্য
বন্ধ
করার
সিদ্ধান্ত
নিল।
নৈতিকতার
তলোয়ার
একমুখী
নয়।
আজ
সাংবাদিক
এবং
বিরোধী
মহলে
যাঁরা
এই
নিয়ে
মোদীর
'একনায়ক'-এর
মুখ
প্রকাশ্যে
আনার
চেষ্টা
করছেন,
তাঁদের
মনে
রাখা
উচিত
যে
দায়িত্বজ্ঞান
শুধু
সরকারের
একার
থাকলেই
চলে
না।
আর
সত্তরের
মধ্যভাগের
যে
জরুরি
অবস্থার
সাথে
এর
তুলনা
করা
হচ্ছে,
তা
নিতান্তই
অবান্তর।
ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর দলবল জরুরি অবস্থা ডেকেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পদকে বৈধতা দিতে। আর সেই রাজনৈতিক প্রকল্পকে সফল করতে সংবাদমাধ্যমের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানো আবশ্যিক ছিল। আজকের ঘটনার সঙ্গে কোনও ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার সম্পর্ক নেই। এখানে আগে মিডিয়া তার সীমা ছাড়িয়েছে আর সরকার তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে সরকারের মাঝে মধ্যে ঘুম ভাঙাটাও কাজের কথা নয়
তবে সরকারপক্ষেরও কোনও দোষ যে নেই, তা বলা চলে না। সরকারপক্ষ বলতে কোনও বিশেষ দল নয়। ২০০৮ সালের সেই ঘটনার পর মিডিয়া যখন সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে দেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছিল নিজেদের ব্যবসায়িক মুনাফার দায়ে, তারপরেও কোনও সরকারের পক্ষ থেকে কেন এদেশের মিডিয়ার জন্য উর্ধসীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি?
কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ বা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ -- কেউই এই ব্যাপারে কোনও আশু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কেন এখনও এদেশে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও প্রক্রিয়া গড়ে উঠল না? মিডিয়ার জন্য 'কোড অফ কন্ডাক্ট' বলবৎ করা কি খুব কঠিন কাজ নাকি আসলে সদিচ্ছারই অভাব?
তাই হঠাৎ হঠাৎ এই ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলে তা কায়েমী স্বার্থকেই মনে করে, সেটাই স্বাভাবিক। আগেই বলা হয়েছে যে গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আর তাই যদি খাতায় কলমে কোনও নিয়মের উল্লেখ না থাকে এই ধরণের বিতর্ক সৃষ্টিকারী ইস্যুতে, তাহলে তো দোষারোপের খেলা চলতেই থাকবে। কোনওদিনই পাওয়া যাবে না স্থায়ী কোনও সমাধানসূত্র।
বিরোধীপক্ষের যেমন মোদীকে দ্বিতীয় ইন্দিরা গান্ধী মনে করারও যেমন কোনও কারণ নেই, তেমনি বেলাগাম মিডিয়াকে লাগাম পড়ানোর সিদ্ধান্তের মধ্যেও কোনও ভুল কিছু নেই। শুধু কাজের ধরনে আরও পরিণতবুদ্ধির চাপ থাকা দরকার।