সমস্যা মুনমুন সেনের 'বেড টি'র অভ্যাসে নয়, তাঁর মতো মানুষদের প্রার্থী করা নিয়ে
পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী মুনমুন সেন এবারে দাঁড়িয়েছেন আসানসোল কেন্দ্র থেকে, লক্ষ্য রাজ্যে বিজেপির অন্যতম দুই সাংসদের একজন বাবুল সুপ্রিয়কে হারানো।
এমন ঘটনা বুঝি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রেই ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী মুনমুন সেন, যিনি কী না পাঁচ বছর আগে বাঁকুড়ার নয়বারের সাংসদ বাসুদেব আচারিয়াকে হারিয়ে লোকসভার সদস্য হন, এবারে দাঁড়িয়েছেন আসানসোল কেন্দ্র থেকে। লক্ষ্য রাজ্যে বিজেপির অন্যতম দুই সাংসদের একজন বাবুল সুপ্রিয়কে হারানো।
ব্যাপারটিকে অনেকেই দুইভাবে দেখছেন। কেউ বলছেন বর্ষীয়ান এই অভিনেত্রী আসলে 'জায়ান্ট কিলার'। আর তাই এবারে তাঁকে বাবুল-বধে নামানো হয়েছে। আবার অন্য আরেকটি তত্ত্ব বলছে যে বাঁকুড়াতে ৯৮,০০০ ভোটে জিতলেও সেখানকার সাধারণ মানুষ তাঁকে গত পাঁচবছর দেখেনইনি বলতে গেলে। আর তাই এবারে তাঁর কেন্দ্র বদলে দেওয়া হল যাতে সাধারণ মানুষ বদলাটি না নিতে পারেন।
সে তৃণমূল কী রাজনৈতিক প্যাঁচপয়জার কষবে সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু নির্বাচনের দিন (২৯ এপ্রিল) যখন তাঁর নিজের কেন্দ্রেই দফায় দফায় গোলমাল বাধে, তখন মুনমুন যাঁর পোশাকি নাম শ্রীমতি দেববর্মা করে বসেন কাণ্ডটি। সংবাদমাধ্যমকে বলেন সকালে যেহেতু তিনি 'বেড টি'টি সময়ে মতো পাননি, তাই তাঁর ঘুম থেকে উঠতেই দেরী হয়ে গিয়েছে এবং তাই গোলমালের খবর তাঁর কাছে পৌঁছয়নি।
'বেড টি' আসেনি বলে প্রার্থী পড়ে পড়ে ঘুমোবেন, তাও ভোটের দিন সকালে?
সোশ্যাল মিডিয়াতে মুনমুনের এই বক্তব্যে মস্করার রোল উঠেছে। একজন লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী ভোটের দিন সকালে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন 'বেড টি'র অপেক্ষায়। এমন রাজকীয় আচার-আচরণের পরে সেটা তিনি আবার সংবাদমাধ্যমকে ফলাও করে বলছেনও।
আসলে এই বলার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। একজন আগাগোড়া গ্ল্যামারের দুনিয়ার লোক যিনি অবস্থাপন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তাঁর পক্ষে 'বেড টি'-র অভ্যাস খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। চাইলে এই পরিণত বয়েসে তিনি সে অভ্যাস বদলাবেনই বা কেন? আর সম্ভবপরই বা কতটা?
ব্যক্তি মুনমুন ও প্রার্থী মুনমুনের তফাৎ
'বেড টি'র পরে ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যাটা তখনই বড় হয়ে দেখা দেয় যখন একজন নির্বাচনী প্রার্থী, তাও যে সে নির্বাচন নয়, খোদ লোকসভা নির্বাচন, বলেন যে তিনি ভোটের দিন সকালে দেরী করে ফেলেছেন ঘুম থেকে উঠতে কারণ তাঁর বিছানা-চা আসেনি। এখানেই চিত্রতারকা মুনমুনের সঙ্গে রাজনৈতিক/নির্বাচনী প্রার্থী মুনমুনের ফারাক। আর সেই ফারাক ঘুচিয়ে ফেলার জন্যে যে পরিশ্রমটি করা দরকার, সেটা বোধহয় সবাই করে না। একজন জনপ্রতিনিধি হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করা রাজনৈতিক কখনই এই কথা বলতে পারেন না।
মুনমুনের আত্মবিশ্বাসই বুঝিয়ে দেয় কেন এই গাছাড়া ভাব
আরও রয়েছে। আসানসোলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বাবুলের নাম শুনে "ওর নাম শুনতে চাই না আমি" বা "তৃণমূল জিতেই গিয়েছে" ধরনের মন্তব্য বোঝায় যে কতটা আত্মপ্রসাদে ভুগছেন মুনমুন সেন। আমি ঘুমোলে কী, ভোটগুলো তো পটাপট আমাদের বাক্সেই ঢুকবে। আর তাতেই কেল্লাফতে। একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে এটা মারাত্মক প্রবণতা। দলীয় রাজ যেখানে সব গিলে খায়, সেখানে ব্যক্তি রাজনীতির পরিসর খুবই গৌণ আর মুনমুনের মতো শিক্ষিতারা যদি সেই পরিসরের শেষ বিন্দুটুকুও ঘুচিয়ে দেন, তাহলে বলার মতো আর কীই বা থাকতে পারে।
চিত্রতারকাদের দেদার নিবার্চনী মনোনয়ন দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো তাঁর দলের জয়লাভের পথ ত্বরান্বিত করছেন, কিন্তু সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির গুণগত মান নিয়ে তা বড়সড় প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে। সেলেব্রিটি প্রার্থীরা হয়তো শুরুর দিকে উত্তেজনা, বিনোদন আমদানি করেছিলেন কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তা এক ট্র্যাজেডিতে বদলে যাচ্ছে।