উরি: পাকিস্তান যতই জঙ্গি হামলা করুক, যুদ্ধ তার কোনও সমাধান হতে পারে না
ঝগড়া তো বরাবরই ছিল, এবার সেটা মারাত্মক আকার নিল। জম্মু-কাশ্মীরের উড়িতে নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি এক সেনা ছাউনিতে জঙ্গি আক্রমণে মারা পড়লেন ১৮ জন জওয়ান। শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে ঘটা এমন ভয়াবহ ঘটনা সমস্ত দেশে ঝড় তুলেছে, তোলবার কোথাও। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে কড়া ভাষায় পাকিস্তানকে আক্রমণ কড়া হচ্ছে। দোষীদের কাঠগড়ায় তুলবই, বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
কিন্তু এতসবের মধ্যেও মনে হচ্ছে, ভারত আদৌ কতটা কী করতে পারবে?
জনসাধারণের কথা শুনলে সরকারের উচিত যুদ্ধ ঘোষণা করা। কিন্তু বিদেশনীতি যে সাধারণ মানুষের আবেগে চলে না, সেটা মোদী সরকার খুব ভালো করেই জানে। উড়ির এই জঘন্য হত্যালীলার পর নয়াদিল্লি কী কৌশল নেবে, সেটা যেমন আশু ঠিক করা মোদীর কর্তব্য, তেমনই এটাও অনস্বীকার্য যে সামরিক ভাবে প্রত্যাঘাত করাটা ভারতের পক্ষে প্রচণ্ড কঠিন কাজ, বলতে গেলে প্রায় অসম্ভবই।
সামরিকভাবে ভারত ঠিক কী করতে পারে? হয় সেনাবাহিনী পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে থাকা জঙ্গি ঘাঁটিগুলি ভেঙে দিয়ে আসতে পারে, পাকিস্তানের একমাত্র বন্দর করাচিকে ঘিরে ফেলতে পারে (ব্লকেড) অথবা পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে আকাশপথে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। অন্যদিকে, কূটনৈতিকভাবে রাষ্ট্রসংঘের মাধ্যমে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মহলে একঘরে করার প্রয়াস চালাতে পারে। আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমি দেশগুলি বা জাপান বা পশ্চিম এশিয়ার কিছু বন্ধু রাষ্ট্রকে নিয়ে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
সমস্যা হচ্ছে, দ্বিতীয়টি অনেক বাস্তববাদী পথ হলেও তাতে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর পাকিস্তানকে 'কড়া শাস্তি' দেওয়ার ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে ওঠা ভারতীয় জনগণ অত অপেক্ষা করার পক্ষপাতী নয়। মোদি যদি ওই দীর্ঘ পথে হাঁটতে যান, তাঁকে "কাপুরুষ", "ভীতু" ইত্যাদি নানা বিশেষণে জর্জরিত হতে হবে।
অন্যদিকে, যেই পথে বীরত্ব দেখানোর সুযোগ অনেক বেশি, সেই পথটি মোটেই সুরক্ষিত নয়, ভারতের পক্ষেও। সামরিকভাবে নীতি প্রণয়নে ভারতের নেতৃত্বকে কোনওরকম আবেগ দেখানো চলবে না, কারণ সামান্য একটি ভুল পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতে পারে। সীমানা পেরিয়ে প্রত্যাঘাত করলে পাকিস্তানী রাষ্ট্র প্রতি-প্রত্যাঘাত করবে, সেটাই স্বাভাবিক আর সেদেশের ভারত-বিরোধী শক্তিগুলি তা চায়ও। একবার যদি পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে এগোয়, তাহলে ইসলামাবাদ বহির্বিশ্বকে দেখাবে কে প্রথমে আগ্রাসনের পথ বেছেছে আর তাতে ভারতের পাল্লা কতটা ভারী থাকবে তা বলা মুশকিল।
যুদ্ধে গেলে ভারতের ক্ষতি আরও বেশি
কিন্তু এসবের চেয়েও বড় আরও কারণ রয়েছে যুদ্ধের পথে না হাঁটার। প্রথমত, ভারতের সামরিক শক্তি যে এই মুহূর্তে দারুন অবস্থায় রয়েছে তা নয়, তা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে যে চিত্রই দেখে থাকি না কেন। ইন্টেলিজেন্স-এর ক্ষেত্রেও আমরা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের মতো পরিপক্কতা অর্জন করিনি যে নিমেষে টার্গেটে আঘাত হানবে আমাদের সেনাশক্তি। উল্টে, তাতে হিতে বিপরীত হয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের আরও ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। আর তাছাড়া, উন্নত অর্থিনীতি এবং ভবিষ্যতের বড় শক্তি হিসেবে স্বীকৃত ভারত যুদ্ধে গেলে তা নিজের পায়ে কুড়ুল মারারই সামিল।
দ্বিতীয়ত, পরমাণু শক্তি। ২০১৬ সালে বসে আমরা যদি ভাবি পাকিস্তানকে নিমেষে উড়িয়ে দেওয়া কোনও ব্যাপারই নয়, তবে সে ধারণা ভুল। অতীতের তিনটি যুদ্ধজয়ের উদাহরণ এখন দেওয়া মূর্খামি কারণ ১৯৪৭, ১৯৬৫ বা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান পরমাণু শক্তিধর দেশ ছিল না আর প্রথাগত যুদ্ধে ভারত বেশি শক্তিশালী ছিল। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানেই পরমাণু পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের এই সামরিক 'লিড' মুছে যায়। এখন পাকিস্তানের আয়তন যাই হোক বা কামানের সংখ্যা যাই হোক, ভারতের মতো তারও পরমাণু অস্ত্র রয়েছে।
অর্থাৎ, দু'টি দেশের সামরিক শক্তি এখন সমান, অন্তত চূড়ান্ত কার্যকারিতায় তো বটেই। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও আমরা একই ব্যাপার দেখছি। ওই দেশটির সামগ্রিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ, কিন্তু শুধুমাত্র পরমাণু অস্ত্র জোগাড় করে ফেলার কারণে আমেরিকা বা চীনের মতো তাবড় দেশকেও তাকে সমঝে চলতে হচ্ছে ।
কাশ্মীরে গত কয়েকমাস যাবৎ যা চলছে, তাতে ভারতের সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। আর এই মুহূর্তে ইসলামাবাদ চাইবে কাশ্মীরি জনগণের 'পক্ষে' লড়াই করার যাতে আরও মনস্ত্বাত্বিক সুবিধা পাওয়া যায়। আর এরপর যদি ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যায়, তবে নয়াদিল্লির মাথাব্যথা বরং আরও বাড়াবে।
তাহলে ভারতের করণীয় কী?
ভারতের করণীয় কাজ তিনটি যদিও আমাদের দেশের অতি-জাতীয়তাবাদী গণমাধ্যমগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে আরও কোনঠাসা করা
প্রথমত, মোদির উচিত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে আরও কোনঠাসা করা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ এইমুহর্তে খুব একটা স্বস্তিজনক জায়গায় নেই। ভারত ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আফগানিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কে বেশ ভাঁটা পড়েছে। নয়াদিল্লিকে এই সুযোগটিকেই আরও কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে মোদিকে চীনের সঙ্গে বার্তালাপ বাড়াতে হবে যাতে পাকিস্তানকে আরও নিরস্ত করা যায়।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও দৃঢ় করা
দ্বিতীয়ত, নয়াদিল্লিকে নিজের প্রতিরক্ষা আরও দৃঢ় করতে হবে। সামরিক শক্তি বলতে শুধু 'অফেন্স' নয়, 'ডিফেন্স'ও বোঝায় এবং ইসরায়েলের থেকে আমরা এব্যাপারে শিখতে পারি। কিন্তু 2008-এর মুম্বই হামলা বা এবছরের গোড়ায় পাঠানকোটে বা এই উড়ির কাণ্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে আমাদের প্রতিরক্ষা এখনও নিশ্ছিদ্র নয়।
কাশ্মীরের পরিবর্তে বালুচিস্তান
আর তৃতীয়ত, ভারতের উচিত পাকিস্তানের বালুচিস্তান এবং গিলগিট-বালতিস্তানে গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড কার্যকরী করা। এর লক্ষ্য একটাই -- ইঁটের বদলে পাটকেল -- কাশ্মীরের বদলে বালুচিস্তান। এতে পাকিস্তানের জিহাদ হয়তো পুরোপুরি বন্ধ হবে না, কিন্তু অবশ্যই সেদেশের সেনাবাহিনীর উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করার ব্যাপারে।
উড়ির পর ভারতের পাকিস্তান নীতি কি হবে, তা মোদি-পর্রীকর-রাজনাথ-দোভালরা ঠিক করবেন, কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে গেলে অবশ্যই যুদ্ধং দেহি মানসিকতা ছাড়তে হবে। যুদ্ধ করে কিছুই হবে না। বরং তাতে বিপদ আরও বাড়বে।