বিনোদনের হরেক মশলা থাকলেও বদহজম হয়নি 'আশ্চর্য প্রদীপ' দেখে
'আশ্চর্য প্রদীপ'-এর রিভিউ লিখতে বসে মনে হল এই লাইনটা দিয়েই শুরু করাটাই যথার্থ হবে। ছবির সমালোচনায় পরে যাচ্ছি। আগে বলে নিই আমার মনে হয়, এ-ছবির ট্যাগ লাইনেই অর্ধেক কাজ সেরে ফেলেছেন পরিচালক অনীক দত্ত। বাকি অর্ধেকটা কাস্টিংয়ে।
প্রথম ছবি ভূতের ভবিষ্যত-এই নিজের ছবি পরিচালনার সহজাত ক্ষমতা প্রমাণ করেছেন অনীক। তাঁর দ্বিতীয় ছবি নিয়েও দর্শকদের যে একটা বিশাল প্রত্যাশা থাকবে সেটাই কাম্য। প্রশ্ন ছিল, অনীক সেটা পারবেন কি না। কোনওরকম সাসপেন্স তৈরি না করেই শুধুমাত্র দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি, সে পরীক্ষায় 'ফার্স্ট ক্লাস' নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনীক।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প 'আশ্চর্য প্রদীপ' অবলম্বনে নাম অপরিবর্তিত রেখেই অনীক এই ছবি তৈরি করেছেন। পুরোদমে বজায় রেখেছেন শীর্ষেন্দুর সেই স্যাটায়ারিস্টিক কমেডি। তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা অনীকের নিজস্ব সিগনেচার হিউমার।
এছবির বাড়তি পাওনা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও রজতাভ দত্তর অভিনয়
সাম্প্রতিককালের ভোগবাদী সমাজ ও ভোগবাদী প্রবণতা- এই উদ্বেগজনক বিষয়টিকেই পরিচালক হাস্যরসের মোড়কে হালকা স্বাদে পেশ করেছেন। হাসি,কান্না,নাচ,গান, বিনোদনের হাজোর মশলা দিয়ে তৈরি করলেও এছবি খিচুরি হয়নি হয়েছে সুস্বাদু অথচ স্বাস্থ্যকর পোলাও। তাই তো বদহজমের সম্ভাবনাটাই নেই।
অনিলাভ গুপ্ত (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। মধ্যবিত্ত গৃহস্থের এক সাধারণ সেলসম্যান। স্ত্রী ঝুমুর (শ্রীলেখা মিত্র)পার্ট টাইমে একটি স্যালোঁয় কাজ করে। সমসাময়িক ভোগবাদের শিকার দুজনেই। চাহিদা আকাশছোঁয়া। অথচ স্বপ্নপূরণের সামর্থ্য় নেই। কী হয় যখন অনিলাভর হাতে আসে আশ্বর্য প্রদীপ। কী হয় যখন অনিলাভর জীবনের মুশকিল আসান হয়ে সেই প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসে জিনি (রজতাভ দত্ত)। এ তো আলাদিনের গল্প। কিন্তু 'আশ্চর্য' প্রদীপ ছবিতে আরও বেশকিছু চমক রয়েছে যা বলাটা বোধ করি ঠিক হবে না।
অভিনেতা হিসাবে এর আগেও শাশ্বত বহুবারই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তবে এছবিতে তাঁর অভিনয় সেরা ,একথা বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। বব বিশ্বাসের সেই নিষ্ঠুর,নৃশংস ঠান্ডা মুখটাকে ছাপিয়ে গিয়েছে অনিলাভর এই নিরেট গোবেচারা লুকটা। তাই শাশ্বতের অভিনয় একশো শতাংশই সফল। অভিনয়ের প্রসঙ্গ উঠলে রজতাভর নামটা কোনওভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। এই ছবির জন্য প্রথমবার নিজের মাথা কামিয়েছেন রণি। জিনি-র চরিত্রে রজতাভর সেই অসাধারণ হাসি উফ্, শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এই দুই দুদে অভিনেতার অভিনয় যে এই ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
শ্রীলেখা মিত্রও চরিত্র অনুযায়ী মানানসয়ী অভিনয় করেছেন। মনোজ মিত্র,পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়,খরাজ মুখোপাধ্যায় নজর কেড়েছেন। কিন্তু মালা মাল চরিত্রে মুমতাজ সরকার কোনও কোনও জায়গায় একটু বিরক্তির উদ্রেগ করে। তবে, ওটুকু মাফ করাই যায় অনায়াসে।
ক্যামেরার ব্যবহার যথাযোগ্য। ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত তেমনই। অযথা ক্যামেরার কাঁপাকাপিতে দর্শকের মাথা ঘুরবে না। তবে এডিটিংটা আরও আটোসাটো হতে পারতো কয়েকটা জায়গায়। গানগুলো মনে ঠিক দাগ কাটে না।
২০০৯-১০ সালে আর এক বাঙালি পরিচালক সুজয় ঘোষ হিন্দিতে আলাদীন ও আশ্চর্য প্রদীপ বিষয়েই একটি গল্প লিখছিলেন ও পরিচালনা করেছিলন। ছবির নাম ছিল আলাদীন। আলাদিনের চরিত্রে ছিলেন রীতেশ দেশমুখ এবং জিনি ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বিগ বি- অভিনয় প্রশংসিত হলেও ছবিটি বক্স অফিসে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। ১৯৮৮-৮৯ সালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এই ছোট গল্পটি অবলম্বনেই নাম অপরিবর্তিত রেখেই ১৫ পর্বের একটি টিলিভিশন ধারাবাহিক শুরু হয়েছিল ডিডি বাংলায়। নায়ক ছিলেন রঞ্জিত মল্লিক এবং জিনি ছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। তবে এক্ষেত্রেও জনপ্রিয়তার চিত্রটা খানিকটা একই ছিল।
কিন্তু অনীক দত্তর 'আশ্চর্য প্রদীপ' সেই চিত্রটা এবার একদম বদলে দিয়েছে। 'ভূতের ভবিষ্যত'-এর ভূত আর 'আশ্চর্য প্রদীপ'-এর দৈত্যের মধ্যে জেতার জন্য এখন জোর লড়াই লেগেছে। দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত কে যেতে।