ব্যক্তিগত থেকে পেশাদার, গানের জগতে দিদি লতাই ছিলেন বোন আশা ভোঁসলের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী
ব্যক্তিগত থেকে পেশাদার, গানের জগতে দিদি লতাই ছিলেন বোন আশা ভোঁসলের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী
গানের জগতে নক্ষত্র পতন। ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কোভিড–১৯ ধরা পড়ার পাশাপাশি তিনি নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হন। মপম্বয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন লতা জি। শনিবার তাঁর অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে দেখতে দৌড়ে আসেন বোন আশা ভোঁসলে। এদিনই দিদিকে শেষ দেখা দেখলেন আশা ভোঁসলে। গানের জগতে লতা–আশা এক মাইলফলকের নাম। সম্পর্কে তাঁরা দিদি–বোন হলেও, আসলে কিন্তু তাঁরা ছিলেন একে–অপরের জোরদার প্রতিদ্বন্দ্বিত।
লতা ও আশার সম্পর্ক
হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের ব্যক্তিগত সম্পর্কের তিক্ততা নিয়ে বহু কথাই শোনা যায়। তবে কোনওদিন তাঁদের দু'জনের সম্পর্কের তিক্ততা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও কথাই বলেননি এই দুই কিংবদন্তি শিল্পী। তবে শোনা যায় গানের জগতে এই দুই নক্ষত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। লতা ও আশার বাবা তথা বিখ্যাত মারাঠি মঞ্চের অভিনেতা-গায়ক পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকরের প্রয়াণের পর দুই বোন প্রথম আঘাত পান। তাঁদের বাবা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শিল্পী। পরিবারের পুরো দায়িত্ব চলে আসে বাড়ির বড় মেয়ে লতা মঙ্গেশকরের ওপর। দিশাহারা লতা সেই সময় বাবার বিশিষ্ট বন্ধু মাস্টার বিনায়কের সাহায্যে সংসার চালানোর দায়িত্ব নেন। এই বিনায়কই লতা জিকে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে সদাশিব রাও নর্ভেকরের পরিচালনায় এক মারাঠি ছবিতে প্রথম গান করেন লতা মঙ্গেশকর।
গানের জগতে দুই বোনের সংঘর্ষ
এরপর ১৯৪৫ সালে বাবার বন্ধুর হাত ধরেই লতা মঙ্গেশকর তাঁর পরিবার নিয়ে মুম্বই চলে আসেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দেন। গানের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য লতা প্রাণপণ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। একই সঙ্গে আশাও নিজেকে গানের জগতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এরই মাঝে আরও এক আঘাত আসে। বাবার বন্ধু মাস্টার বিনায়কের মৃত্যু আরও একবার লতা-আশার জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে। তবে তখন লতা মঙ্গেশকর কিছুটা হলেও পরিচিতি পেয়েছেন। এরপর লতা তাঁর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের জায়গা করে নেন প্লেব্যাক গায়িকাদের স্তরে। ততদিনে আশাও প্রায় দিদির সঙ্গে সঙ্গে গানের জগতে ঢুকে পড়েছেন। শোনা যায়, আশা ভোঁসলে অনেকবারই আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে দিদি লতার সমর্থন পেলে তাঁর হয়ত প্রতিষ্ঠিত হতে কম সময় লাগত। তবে এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল আশা ভোঁসলের বাড়ির অমতে বিয়ে।
সম্পর্কের তিক্ততা শুরু
লতার নিজ-সহায়ক ৩১ বছর বয়সী গণপতরাও ভোঁসলের সঙ্গে ১৬ বছরের আশা পালিয়ে বিয়ে করেন। বছর কয়েক অসুখী বিবাহিত জীবন কাটিয়ে যদিও আশা মায়ের কাছে ফিরে আসেন, তবুও লতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঠিক হতে কয়েক দশক সময় লেগেছিল। ১৯৫০-এর দশকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী লতা প্রথম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেন তাঁর বোন আশার কাছ থেকে। শোনা যায় ১৯৫৭ সালে শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন লতা। সেই সময় টানা পাঁচ বছর তাঁর কোনও ছবিতে গানের সুযোগ পাননি লতা। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আশা নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। যে ম্যাজিক পরের চাঁর পাঁচ দশক শ্রোতাদের মোহিত করে রেখেছিল।
লতা ও আশা ছিলেন দুই ভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী
ক্যাবারে থেকে রোম্যান্টিক, সব গানেই দক্ষ আশা ভোঁসলে। নিজের গলাকে কীভাবে কখন কোন গানের মধ্যে মডিফাই করতে হয় আশা যেন সেই কৌশল জন্মগতভাবেই পেয়েছেন। অথচ লতার কন্ঠে সফট, রোম্যান্টিক, দেশাত্মবোধক গান ছাড়া সেভাবে কোনও গানই মানাতো না, তাই লতার চেয়ে বেশি একটা সময়ে আশার চাহিদা বেশি দেখা গিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। এরপর আর ডি বর্মনের সঙ্গে বিয়ের পর তাঁর সব সিনেমাতেই প্রতিপত্তি দেখা গিয়েছিল আশার। শোনা যায়, বাংলা গানের জগতে লতার পরপরই আশা প্রবেশ করেন। ফলে সেখানে টক্কর ছিল তুঙ্গে। ইন্ডাস্ট্রির পুরনো গানের মানুষেরা অবশ্য বলেন লতা-আশার গানের সফর ছিল ভিন্ন।
লতা–আশার সম্পর্ক নিয়ে সিনেমা
কিছু বছর আগে লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের সম্পর্ক নিয়ে তৈরি হয়েছিল 'সাজ' নামের একটি সিনেমা। যেখানে দেখানো হয়েছিল যে বড়বোন কীভাবে ছোটবেনের কেরিয়ার নষ্ট করতে চাইছেন। যদিও এই সিনেমা নিয়ে বিতর্ক যথেষ্ট হয়েছিল।
সম্পর্ক নিয়ে দুই বোনের প্রতিক্রিয়া
বর্তমানে দুই বোন মুম্বইয়ের পেডার রোডে প্রভুকুঞ্জে পাআপাশি দুই ফ্ল্যাটে থাকতেন। এক সাক্ষাতকারে লতা জি বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, অতীতে আমাদের দুই বোনের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে কিছু দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তেমনটা প্রায় সব ভাইবোনের সম্পর্কেই হয়ে থাকে। ও অল্পবয়সে কিছু কাজ করেছিল, যা আমি সমর্থন করি নি।' অন্যদিকে দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার গুঞ্জনে একবার এক সাক্ষাৎকারে মুখ খুলেছিলেন আশা ভোঁসলে নিজেই। আশা বলেন, 'ও আমার বোন এবং আমার প্রিয় শিল্পী। মানুষ গল্প বানাতে ভালোবাসে, সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু রক্ত জলের চেয়ে ঘন।' প্রসঙ্গত, গানের দুনিয়ায় আশা ভোঁসলে এবং লতা মঙ্গেশকরের কিছু বিখ্যাত ডুয়েট গান রয়েছে। যার মধ্যে 'কেয়া হুয়া ইয়ে মুঝে কেয়া হুয়া', 'মন কিউ বেহকা রে বেহকা আধি রাত কো', 'যব যব তুমহে ভুলায়া তুমি অউর ইয়াদ আয়ে', 'কোই আয়েগা আয়েগা' সহ আরও বেশ কিছ গান রয়েছে।
'হেমন্তদা’র জন্যই আনন্দমঠে 'বন্দেমাতরম’ গেয়েছিলেন লতা, তারপর ইতিহাসে তাঁদের জুটি