১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট জন্ম হয় অভিনেত্রী রাখীর, জানুন সেই অজানা গল্প
রাত পোহালেই দেশের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের সূর্যোদয় দেখতে পাবেন দেশবাসী। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট আমাদের ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল। আর ঠিক এইদিনই জন্ম নিয়েছিলেন দেশের বরিষ্ঠ ও কিংবদন্তী অভিনেত্রী রাখী গুলজার। যিনি আমাদের একাধিক ভালো ভালো সিনেমা উপহার দিয়েছেন।
১৫ অগাস্ট জন্ম
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটে জন্ম নেন অভিনেত্রী রাখী মজুমদার। তিনি সেখানকার এক স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করতেন। ভারত বিভাজনের পূর্বে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) তাঁর বাবা জুতোর ব্যবসা করতেন। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এসে থাকতে শুরু করেন।
হিন্দি সিনেমায় তাঁর সফর শুরু
রাখী মাত্র ২০ বছর বয়সে তাঁর সিনেমা জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে রাখী বাংলা ছবি বধূবরণ-এ অভিনয় করেন। এরপর ১৯৭০ সালে তিনি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পান। জীবন মৃত্যু সিনেমায় ধর্মেন্দ্রর বিপরীতে অভিনয় করেন রাখী। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রাখীকে। তাঁর বাঙালী সৌন্দর্য ও অভিনয় দেশের সকল দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। ১৯৭১ সালে শর্মিলী চলচ্চিত্রে শশী কাপুরের বিপরীতে দ্বৈত চরিত্রে অবতীর্ণ হন। একই বছর লাল পাত্থর ও পরস ছবিতে অভিনয় করেন। এই তিনটি সিনেমাই দারুণ হিট হয়। পরবর্তী দশকে শেহজাদা, হীরা পান্না, দাগ: অ্যা পোয়েম অফ লাভ, হামারে তুমহারে, আঁচল ও তাকত সিনেমায় অভিনয় করেন রাখী। তার মধ্যে ব্ল্যাকমেইল ও তপস্যা সিনেমায় তাঁর অভিনয় এখনও অবিস্মরণীয়। হীরা পান্না, বেনারসি বাবু, লুটমার ও জোশিলা সিনেমায় দেব আনন্দের সঙ্গে তিনি অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও রাখীর ঝুলিতে রয়েছে কভি কভি, জানোয়ার অউর ইনসান, দুসরা আদমি, বসেরা।
খুব কম বয়সে বিয়ে হয় রাখীর
১৯৬৩ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে রাখীর বিয়ে হয়ে যায়। রাখী মজুমদারের নতুন পরিচয় হল রাখী বিশ্বাস। কিন্তু মাত্র দু'বছরেই ভেঙে গেল সংসার। পরিচালক, সাংবাদিক অজয় বিশ্বাসকে ছেড়ে একা থাকতে শুরু করলেন রাখী। বিচ্ছেদের পরই তিনি অভিনয় জগতে নিজের পরিচয় তৈরি করেন। নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব আর অভিনয়ের গুণে অল্প সময়ের মধ্যেই রাখী চলে এলেন ব্যস্ত নায়িকাদের তালিকায়।
শশী কাপুর ও অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে জুটি বাঁধেন
নায়কদের মধ্যে সবথেকে বেশি জুটি বেঁধেছেন শশী কপূরের সঙ্গে। মোট ১০টি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে অভিনয় করেছেন দু'জনে। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও রাখীর জুটিও বক্স অফিসে দারুণ সফল। 'কভি কভি', 'বরসাত কি এক রাত', 'মুকদ্দর কা সিকন্দর', 'কসমে ভাদে', 'ত্রিশূল', 'কালা পাত্থর', 'বেমিশাল', 'জুরমানা'-র মতো সফল ছবি উপহার দিয়েছে এই জুটি।
বাংলা সিনেমায় তাঁর অবদান
হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি বাংলা ছবিতেও নিজের অভিনয়ের ছাপ ফেলেছেন এই অভিনেত্রী। তিনি ভুলে যাননি বাংলাকেও। বাণিজ্যিক মূল স্রোতের ছবির পাশাপাশি বাংলার দর্শকদের মনের মণিকোঠায় তিনি থাকবেন অপর্ণা সেনের 'পরমা' এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের 'শুভ মহরৎ' ছবিতে অসামান্য অভিনয়ের জন্য। সিনেমা থেকে দূরে সরে থাকার দীর্ঘ সময় পরে ফিরে এসে তিনি অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচলনায়। 'শুভ মহরৎ' ছবির জন্য তিনি সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হন। এছাড়া গৌতম হালদারের পরিচালনায় 'নির্বাণ' সিনেমায় দেখা গিয়েছে এই অভিনেত্রীকে। মতি নন্দীর উপন্যাস 'বিজলিবালার মুক্তি' অবলম্বনে এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন রাখী।
পদবী ব্যবহার না করা নিয়ে বিতর্ক
ছবিতে অভিনয় শুরুর সময়ে রাখী কোনও পদবি ব্যবহার করতেন না। কিন্তু সেই রাখী নামের পাশে লিখলেন 'গুলজার'। ১৯৭৩ সালে পরিচালক তথা কবি গুলজারকে বিয়ে করার পরে। কিন্তু বাঙালি কন্যার সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য স্থায়ী হল না। ১৯৭৪ সালে, তাঁদের মেয়ে মেঘনার যখন মাত্র এক বছর বয়স, আলাদা হয়ে গেলেন রাখী ও গুলজার। তবে তাঁরা কোনওদিন খাতায়কলমে ডিভোর্স করেননি। মেয়ে যাতে কোনও দিন বাবা-মায়ের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত না হয়, সে দিকেও খেয়াল রেখেছেন দু'জনেই।
সিনেমা থেকে বিদায় নেন রাখী
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে রাখি সরে যান চরিত্রাভিনয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৃদ্ধা মা বা স্বামীহীনার ভূমিকায়। উল্লেখযোগ্য হল 'রাম লক্ষ্মণ', 'আনাড়ি', 'বাজিগর', 'খলনায়ক', 'করণ অর্জুন', 'বর্ডার', 'সোলজার'-এর মতো ছবি।
নিজের জীবন কাটিয়েছেন স্বাধীনভাবে
স্বাধীন দেশের মতোই রাখীও নিজের জীবনেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি কোনও দিন। বাঁচতে চেয়েছেন নিজের শর্তে। পুরুষশাসিত সমাজে রাখী স্বাধীনভাবে নিজে যেটা চেয়েছেন সেটাই তখন করেছেন। না বাবার না স্বামীর কারোর পদবী ব্যবহার করতেন না রাখী। যা নিয়ে সেই সময় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকী গুলজারের রক্ষণশীল মানসিকতা মেনে নিতে পারেননি তিনি, তাই সেই বন্ধন ছেড়েও বেরিয়ে আসেন রাখী। ইদানীং তাঁকে পার্টি বা অন্যান্য অনুষ্ঠানেও দেখা যায় না। ইন্ডাস্ট্রির আলো থেকে রাখী পছন্দ করেন নিজস্ব ফার্ম হাউজে অসংখ্য আদরের পোষ্যের মাঝে সময় কাটাতে। একমাত্র নাতি, মেঘনার ছেলে সময়ও রাখীর খুবই কাছের। দেশের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের পাশাপাশি হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীর স্বাধীনচেতা এই অভিনেত্রীর ৭৫তম জন্মদিনে রইল অসংখ্য শুভেচ্ছা।